ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

বেশ  কিছুদিন পর  কোন কারনে  যাত্রাদলের অধধিকারী  গোবিন্দ  দাস  অধিকারীর সাথে  মনোমালিন্য  হয়,কারন,গোবিন্দ অধিকারী  নীলকন্ঠকে মাসিক সাত টাকা  মাইনে  দিতেন, আসরে  দর্শক  শ্রোতারা অভিনয়  ও গান শুনে  খুশী  যে  টাকা  পুরস্কার  দিত  তার  সব নিয়ে  নিতেন  অধিকারী। তাতে  নীলকন্ঠ  কোন  প্রতিবাদ  না  করলেও  তিনি খোঁড়া হওয়ায়   কাশীপুরের। রাজা। তাঁকে একটি  ঘোড়া দেন । কিন্তু গোবিন্দ  অধিকারী সেই  ঘোড়াটি জোর  করে  নিতে চাইলে  ক্ষোভে   তাঁর দল  ছেড়ে  ভাই  শ্রীকন্ঠ, স্মৃতি  কন্ঠ ও হরেকৃষ্ণ বাগকে নিয়ে  নতুন  কৃষ্ণ যাত্রার দল  খুললেন। 
                নীলকন্ঠ  বিন্দেদূতীর চরিত্রে অভিনয়  করতেন। তিনি  বর্ধমান,সিয়ারসোল,কাশীপুর,সিংভূম  হেতমপুর ,বিষ্ণুপুর,ঢাকা সহ বিভিন্ন  রাজবাড়িতে । তাঁর বাঁধা  আসর  ছিল। তবে কাশীপুর, বর্ধমান  ,হেতমপুর আর  সিয়ারশোল  রাজবাড়িতে তাঁর বাড়তি  খাতির  ছিল। নিজে  নিরক্ষর  হয়েও  কাশীপুর -এর  রাণীকে  তিনি  রামায়ন  শোনাতেন।  কাশীপুর এর  রাজা তাঁকে  প্রচুর  সোনার  বাসন  দান করেন। 
               তাঁর পদাবলী  গানের  ভক্ত  ছিলেন  রামকৃষ্ণ পরমহংস  স্বয়ং, তিনি  দক্ষিণেশ্বরে  এসে  ঠাকুর  রামকৃষ্ণ পরমহংস  দেবকে  গান  শোনাতেন। স্বামী  বিবেকানন্দ তাঁর পদাবলী  গান  গাইতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  তাঁর  গুণগ্রাহী  ছিলেন। তিনি  সহজ  পাঠ  বই-এ  এক স্হানে  নীলকন্ঠের  প্রসঙ্গে লিখেছেন " আজ  কন্ঠ  মশাই এর  গান শুনতে  যেতে হবে। "
                   তিনি  শাক্ত  পরিবারে  জন্মেও  রাধাকৃষ্ণ এর  উপাসক  ছিলেন।তাঁর পরিবারে  শাক্ত  ও বৈষ্ণব  ধর্মের  এক  অপুর্ব  মেলবন্ধন  দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ীতে  শাক্ত মতে  পাকা  মন্দিরে  কালী  ও দুর্গা পূজা হয়  আবার  রাধা কৃষ্ণের নিত্য  ভোগ  হয়। 
                        তিনি  এক  ব্যতিক্রমী  পুরুষ।স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য  কাশীধামে গেলে  সেখানে ভাই  স্মৃতিকন্ঠ  দেহ  রাখলেও  ফিরে  আসেন  নীলকন্ঠ। নীলকন্ঠের  গান  কেবলমাত্র তাঁর জীবিকার  অবলম্বন  ছিল না।  গানে চিত্ত  মন  হৃদয়ের গভীর  সংযোগ  ছিল  তাঁকে এক  অনির্বচনীয়  আনন্দানুভুতি  দিত। 
             ত্রিবেনীতে  গঙ্গায়  দেহ রাখবেন  স্হির  করে  সেখানে  একটি  ঘর ভাড়া  নেওয়া  হ'ল।  নির্দিষ্ট  দিনে  ত্রিবেনীর  উদ্দেশ্যে  ধবনী  থেকে  যাত্রা  করলেন  শোভাযাত্রা  সহকারে। সাথে  নিলেন মানকরের  রাম কবিরাজ, পুরোহিত  শিবপ্রসন্ন ভাইপো  শম্ভুনাথ ও পুত্র   কমলাকান্ত।   পার্শ্বগ্রামগুললির প্রায়  কয়েক'শ  মানুষ  খোল  করতাল  বাজিয়ে   চোখের জলে  বুক  ভাসিয়ে প্রিয়  মানুষটিকে  বিদায়  জানিয়ে  ছিল। 
           ১৩১৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ। গঙ্গাবক্ষে বুক সমান  জলে দাঁড়িয়ে পর পর  সাত খানি  গান  মুখে  মুখে  রচনা  করে  গাইলেন পুত্রকে বাড়ী ফিরে গিয়ে  তার  জননীকে  ভার  নিতে  নির্দেশ  দিয়ে।  তাঁর শেষ  গানটি  গাইতে  বললেন।  কমলাকান্ত  ভগ্ন হৃদয়ে  সাশ্রু  নয়নে  গান গাইতে  লাগলো " আমি  যখন  আমি  নই ,মন  আর  মরন  ভয় কি  আছে।  
যাঁর। জীবন তাঁরই মরন,তাঁর ভাবনা  সেই  ভাবিছে।..... "
           অনন্তলোকে বিলীন  হয়ে গেলেন  এক  ক্ষণজন্মা  সাধক। যিনি  কৃষ্ণযাত্রায়  মতো  এক। মাধ্যমকে অবলম্বন করে  আধ্যাত্মিক চেতনার  উন্মেষ  ঘটিয়ে ছিলেন।  শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের এক অপুর্ব মেলবন্ধন  ঘটিয়ে ছিলেন।তাঁর স্বেচ্ছা মৃত্যুর সাথে  সাথে  একটি যুগের অবসান ঘটল। (চলবে)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours