আবীরা গঙ্গোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা:

সত্যজিৎ এর সত্তর?
শুনেই বলি ধুত্তর...
কবির নাম মনে নেই। মনে নেই পুরো কবিতাটা। তখনো আনন্দমেলার নিয়মিত পাঠক। কোনো একজন ,বিখ্যাত কবি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সত্তর বছরের জন্মদিনে ।বক্তব্য চির তরুন সত্যজিৎ রায়ের সত্তর বছর কখনোই হবে না। অর্থাৎ বুড়িয়ে যাবেন তিনি কোনোদিনই। আজ নিরানব্বই বছর পার হয়ে যাওয়া এই মানুষটির সম্বন্ধে লিখতে বসে মনে হচ্ছে...সত্যিই কী তবে তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন? আজকের প্রজন্ম কেন আর আমাদের মত নাওয়া খাওয়া ভুলে গোগ্রাসে গেলে না ফেলুদা?
বইপোকা একটি মেয়ে,  ফেলুদার বই পড়ে হেলেদুলে। দু পাতা পড়ে বন্ধ করে রেখে দেয় দিব্যি। তিনদিন পরে আবার হয়ত খুলে পড়ে চারপাতা। অথচ এই মেয়েই, সত্যজিৎ রায়ের লেখা ছোটো গল্প  অঙ্কস্যর, গোলাপীবাবু আর টিপু তিনবছর আগে এক টানা পুরোটা না শুনে ,পড়া থামাতে দেয় নি।  'কেন রে ভালো লাগে না ফেলুদা?' মুখ নিচু করে উত্তর দেয় মেয়ে, ' ফেলুদা একাই কেন সব পারবে বলত ? ওর সবই ভালো!' তাইতো এই কথাটাই তো ক্লাস ইলেভেন আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়া মেয়ে শাওনা মিত্র বলেছিল...ক্লাস টীচার সত্যবতীদির ক্লাসে। সবাই বলেছিল ফেলুদা ভালো লাগে। শাওনা একমাত্র বলেছিল, ফেলুদা ভালো লাগেনা..।ফেলুদার সব কিছুই ভালো বলে.। শাওনা ইলেভেনে যা বলেছিল, আজ সেভেনের মেয়ে তাই বলছে! সময় কী দ্রুত বদলাচ্ছে! লেখক হওয়ার প্রথম পাঠ পড়েছিলাম সেই দিনই, সেই ক্লাসেই। নায়কের সবটাই ভালো হলে...সে নায়কই হয়।  কিন্তু অনেকের কাছেই কাছের মানুষ হয়ে ওঠে না। পাঠক তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারে না। তাই বোধহয় আজকের ছেলেমেয়েদের ফেলুদা চুম্বকের মত টানে না, যেমন টানত আমাদের ।.কারন যৌবনে পৌঁছনোর আগে আমাদের পার হতে হত এক স্বপ্নময় কৈশোর। আর্দশ নীতি ভালোলাগা, প্রিয় মানুষ , মনের মত মানুষ আর স্বপ্ন ঘিরে থাকত যে কৈশোর। আমরা বিশুদ্ধ  দু একজন মানুষ দেখতে  পেতাম আশপাশে। আজকাল ছোটোরা ছোটোর থেকেই বড় হয়ে যায়, চিন্তা ভাবনাকে যান্ত্রিকতায় মুড়ে। জীবনে ..নম্বর পাওয়া ...আরো নম্বর পাওয়া...দাঁড়ানো আর টাকা রোজগারই এখন জীবনের লক্ষ্য। ভালো লাগার সঙ্গে সময় কাটানোর ,এক মুহূর্ত  বসে ভাবার , মনের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই এই জীবনে । তাই আমাদের ক্লাসের একজন শাওনায় আজ পুরো ক্লাস ভরপুর। ফেলুদার ফ্যান খুঁজে দেখতে হয়।
কঠিন অসুখে পরে ছোটোবেলার অনেক কিছু ভুলে যাওয়া বান্ধবী যখন ছেলেবেলায় লেখা চিঠি খুঁজে পেয়ে বলে..'তুই আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম নারে?' প্রমান দিতে বলি..' বারে ভুলে গেলি তুই আর আমি কম্পিটিশনে ফেলুদা পড়তাম..!'  ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হল যেদিন, ঘুম থেকে উঠে পড়ার মত গল্পের বই নেই বলে..মন খারাপ করাতে, বাবা পুরোনো পুজা বার্ষিকী দেশ পত্রিকা খুলে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল কৈলাশে কেলেঙ্কারী। শেষ করে নেমে ছিলাম বাসি বিছানা থেকে ।সেই শুরু..। আট ,দশ ,বারো টাকার সত্যজিৎ রায়ে আমার বই এর আলমারীর তাক ভরা। হাতে টাকা পেলেই..বেশির ভাগটাই পাওয়া যেত..দিদার হাত থেকে, এক ছুট্টে মীরা গ্রন্থাগার থেকে সত্যজিৎ রায়ের বই কিনে আনা। এসব কিছুই নেই আজকের প্রজন্মের মধ্যে । তারা ফেলুদাও পড়ে ইংরেজিতে,  অনুবাদে।
তবে কী ফেলুদা, তার গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতিও প্রাসঙ্গিকতা হারালো আজকে?নতুন দিনের ছেলে মেয়েদের আকর্ষন করে না ..সত্তর ,আশি, নব্বই এর দশকের পুরোনো পদ্ধতি..? তা হলে তো . শার্লক হোমসও জনপ্রিয়তা হারাত..। আসলে তা নয়. .ফেলুদা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে মা বাবাদের দোষে। ঝরঝরে বাংলা শেখানোর আগ্রহেও  যে আমরা সঠিক সময়ে তুলে দি না ছেলেমেয়েদের হাতে বই গুলো। বাংলাটা ঠিক আসছেনা হা হুতাশের থেকে যখন তুলে দি...তখন ফেলুদার চরিত্রের কাঁটা ছেঁড়ার বয়স হয়ে যায়। হিরো ওরশিপের বয়স চলে যায়। ফেলুদাও. তাই আর কলকে পায় না। সত্যজিৎ রায় এর ঝরঝরে লেখনীও আর বাংলা লেখা শেখাতে সক্ষম হয়না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours