প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

কাগজে লীলা  করে  মামুলী কাহিনি;  চেনা গল্পে শিল্প নির্দেশনা বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সম্পাদক দুলাল দত্ত,দুই আঁকড়ে কেটে দিয়েছে পূর্ণচ্ছেদ।। যাত্রাভিনয়।। " নিউবাণী অপেরা পার্টি,।। সংগীত।। রবিশঙ্কর, হ্যাঁ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় "সত্যজিৎ রায় "।

ভাঙা বাড়ির মনঃসমীক্ষা যখন বিশ্বজীবনের প্রতিবিম্ব হয় তখনই তো বলতে হয় " saw eternity in a grain of sand." এ এক মনোধর্মের প্রতিশ্রুতি জীবনবোধ। বাঁশ বাগানে লুকোচুরি শৈশব বেয়ে বেড়ায় দৈন্যের বঙ্গপল্লী গোষ্পদ ; চরিত্রের গভীরে ইন্দির ঠাকরুণ, বিবর্তনের ব্যর্থ প্রত্যাশার সঙ্গী। ঘরে বাইরে তিনি হেনস্থার আধার। দুঃখের জীবনে যখন কুঁড়েটি একমাত্র সান্ত্বনার স্থল, তখন ইন্দির ঠাকরুন সেকালের অবসান পথ৷ পিসী ভাইজির এ ভালোর আলাপ যেন বলে দেয়, তখনকার দিনে এতো বালবিবাহ, বহুবিবাহ ও কৌলীন্যপ্রথার বলি সাক্ষ্মী গোপাল ; তাচ্ছিল্যের সংসারে অধোগতি তো তাঁদের
দায় নয়, নোংরা ছেঁড়া কাঁথার গন্ধ যে তাঁদের  দায় নয়, এ দায় সমাজের। তাঁরা বয়সের ভারে নুব্জ হৃদয়ে হয়তো বলেছেন ছবির পর্বের মতো, "হরি দিন তো গেলো, সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে.. "।

ইন্দির ঠাকুরের রাগের পরাগ যেন অচিরে ভেঙে দেয় প্লটে অপুর আগমন৷ এই যে দিনলিপি ভাষা। এমন সমাজ, মানুষ তো কল্পনার রঙ মিশিয়ে তথ্যের রূপান্তর সাধন করতেই বলে৷ কোথাও সজনীকান্ত দাসের কাছে বিভূতিভূষণ  " অপু " স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, আত্মসচেতনে নয়, একাত্মতায়। মাঘ মাসে খোকা আর বৈশাখ মাসে হরিহরের চাকুরি খবর, এ যেন প্রাপ্তি পুত্রযশ। সমাজ বড়ো অধীর হয় দেহাতী কিশোরীর অন্যায়ে, কিন্তু পুত্র পুনর্লিখন হয়।  একফালি বাগান সে সমাজের সংসারের জন্য কতটা শিল্পীমন তা বুঝি আর মেপে নেওয়া যায় না। হরিহরের নতুন পালা স্বপ্ন দেখায় নিত্য। নিত্য পুঁই শাকের রান্নায় কোপটা  কালিয়া রান্না হবে, পাকা বাড়ি হবে, অপু লেখাপড়া শিখবে, দুর্গার একটা ভালো পাত্র আর বছরে দুটি পরনের কাপড় আর কি লাগে!
পুরানো লতাপাতা,  একপয়সার মুড়ি,  মায়াময় সন্তান সুখ,  দারিদ্রের অসুখ,  পাঠশালার শ্লেঠ নিয়েই ত্রিতত্ত্বের সমন্বিত জীবন চেতনা৷ দীঘিভরা জলের বুকে বক সহচর।  দুর্গার গায়ে জ্বর, অপুর ছেঁড়া জামা, তবুও প্রকৃতির বুকে ঝড়া বাঁশ পাতায় সোহাগী নিশ্চিন্দপুর। জীবন বড়ো নিষ্পাপ হয়, দাগ কাটে অর্থের ভ্রুকুটি। পুতুল খেলার সাথে পিসির মুখে লাল কমল, নীল কমল কাহিনি,  মহাভারতের কাহিনি অপুকে সময়ের স্থান কাল পাত্র এক করে দেয়। পোড়া মন্দির, কাশ ফুলের সারি, মৌন সমাজের চিত্র আঁকে।

কালের প্রান্তে দাঁড়িয়ে কান্নার অছিলায় প্রকৃতি কুরূপ  হয়৷ গণেশ মূর্তি টলতে থাকে। প্রদীপের আলো নিশ্চিন্তে নিভে যেতে থাকে৷ বজ্রের আলো দুর্গার মুখে এসে পড়ে৷ তরঙ্গ হিল্লোলে পদ্মপাতা স্তিমিত হয়। মায়ামাখা মুখ বড়ো তাড়াতাড়ি নিভে যায়।

সময় কাটে জীবনের ঘোরে। কতো শতেক মুখই তো এমন আসে, কিন্তু টিকে থাকে কয়জন৷ মায়া সঞ্চয় হয় রোজ। তবে কি শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের মণিকেই আদর করে সিনেমার প্লটে এঁকেছিলেন!  বাস্তবগন্ধী হরিহর যেন ডিকেন্সের মিকবার চরিত্র। ঘটনাগত ও চরিত্রগত প্রবাহে হরিহর মিকবার নয়। তবে কি যাযাবর জীবনের সহানুভূতি ও করুণা একান্ত আর্তনাদ।

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র এক মানতাবাদ৷ তবে কি "রাজকীয় শামুক " মূল্যবানের পথ!  না, বরং শান্তভাবের তরঙ্গ বিহ্বল নদী৷ অভিযোগকারীদের কাছে, "দারিদ্র রফতানি"- এর কারগর তিনি, না, ও কথা অবার্চীন সব৷ নিপীড়িতের প্রত্যয়ী ভাবনার মূলেই তো সহজ লক্ষ্যের সমাধান, তাঁর অসামান্য আবেদন মনোগ্রাহী।  শতবর্ষ আলোকে তিনি আমাদের জীবনে যুক্তিসঙ্গত উপসংহার ", নমী প্রগতি ইতিহাস তোমায়, তুমি চেতনার বাণী।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours