স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

 “ভর পেট নাও খাই এক পেট সুরা চাই। ‘‘ এই উন্মাদনায় ভাসছে সারা রাজ্য। নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে , দুটি করে বোতল পাবে। একটা রেশনিং। অবশ্য এই রেশন শব্দটা নিয়ে এখন না বলাই ভালো । সারা দেশ এখন করোনা মারণ ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুপুরীতে রুপ নিতে চলেছে। আটকানোর সবরকম চেষ্টা ইতিমধ্যেই বিফলে। কি করে এই সঙ্ক্রমণকে আটকানো যায় , সেটা নিয়েই চলছে নিরন্তর গবেষণা। দেশের এই মুহূর্তে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ আধপেটা খেয়ে দিন গুজ্রান করছেন। দশ শতাংশের পেটে একমুঠো খাবার জুঠছে কি জুঠছে না, সে খবর নেবার লোক নেই। সংক্রমণ একমাত্র ঠেকাতে পারে সামাজিক দুরত্ব ও কিছু সামান্য পালনীয় দৈনন্দিন অভ্যাস। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে। সেটা দেশের সরকার প্রতিটি রাজ্য সরকার ও সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ ও প্রার্থনা করেছে। সেই অনুরোধ উপরোধ চুলায় তুলে দিয়ে আমাদের এই রাজ্যে করোনার মৃত্যুদুতকে সাদরে ঘরের ভিতরে ডেকে নিয়ে এসেছে। এইসব কথা এখন বলে আর কি হবে ? এই মৃত্যু দূতের কারনামা ইতিমধ্যেই যে কতটা ভয়ংকর তা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়ে গেছে। তারা তাদের যে চিঠিটি রাজ্য সরকারের কাছে দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, (বিরোধীদের অভিযোগ) তথ্য গোপন করেও যে হিসেব আমাদের সরকার দিয়েছে, তাদেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর অনুপাতে ,পশ্চিমবঙ্গ একেবারে সবার উপরে। এই অনুপাত প্রায় ১৩ শংতাংশের কাছে। ফলে আমাদের রাজ্য যে কতটা ভয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে সেটা এই বিষয়টা থেকেই পরিস্কার।আমাদের গোটা রাজ্যের দশটি জেলাকে এই কারণে রেড জোনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ( এই বিষয়টা এখন আর স্বাস্থ্য মন্ত্রক দেখছে না )। সেটা নিয়ে খুব গোসা রাজ্যের। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, সেই কারণে লক ডাউন করে মানুষকে ঘরবন্দি করার একটা চেষ্টা করেছে সরকার। কিন্তু আমাদের এই রাজ্যে সেটা আর হোল কই ? এই সব কথা গুলি বলার উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের কোন কিছুকে না মানার মানসিকতাকে আর সবজান্তা মনোভাব নিয়ে অতি বড় বিপদকে কাছে টেনে আনার যে প্রচেষ্টা , সেটাকে সামান্য হলেও বোঝাবার চেস্তা করা।
গতকাল রাজ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে মদের দোকান। সুরাপ্রেমীদের দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল সরকারের। আমাদের রাজ্য আবার একটু অন্যরকম। সেই নোট বন্দির সময়েও দেখা গেছে। মানুষের দুঃখে একেবারে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল রাজ্যের শাসকদল থেকে বিরোধীরা। সেই সময়ে এটিএমের লাইন, আর সেখানে একজনের সেই লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল সারা রাজ্য। দেশ একেবারে শেষ হয়ে গেল , এমনটাই বলা হয়েছিল সেই সময়ে। আর এই সময়ে, যখন দেশের মানুষের সামনে অজানা অবস্মভাবী মৃত্যুর হাতছানি। রাজ্যের মানুষের কাছে একমুঠো অন্ন যোগাড়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কথা কতটা ভাবলেন আমাদের রাজ্য সরকার ? গতকাল মদের দোকানের সামনে লম্বা লাইন, মারামারি দেখে মনে হল , যে আমাদের রাজ্যে সব কিছু রসাতলে গেলেও মদ্যপান যেন ঠিক থাকে। নিরন্ন পেটে একমুঠো অন্ন তুলে দেবার জন্য প্রচেষ্টা এই মদের দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষদের যে নেই সেটা গতকালই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের রাজ্যের বেশ কিছু মানুষ। এই মানুষগুলোই বেশি সরব হয়েছিল সেই নোট বন্দির সময়ে , একথা নির্দ্বিধায় বলে যেতেই পারে । কেননা এই প্রতিবেদক কাল নিজের এলাকায় যাদের অইলাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, তাদের সিংহ ভাগকে নোটবন্দি বিরোধী মিছিলে যেমন হাঁটতে দেখেছে, আবার সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং না মানার মানসিকতাতেও দেখেছে। যদি একথা বিশ্বাস না হয় , খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন ? সংবাদ মাধ্যম বেশ রসিয়ে রসিয়ে সুরাপ্রেমীদের প্রতি দরদে উথলে উঠে খবর করেছে। কিন্তু একবারের জন্য নিরন্ন মানুষদের মুখের দিকে তাকিয়ে, এই মুহূর্তে এই সুরাপ্রেমীদের আনন্দের উচ্ছ্বলতার ছবি কি সমাজকে খুব একটা ভালো বারতা দিল ?নেটিজেনরা তাদের মত করে সরব হয়েছেন। অবশ্য তাদের কথা কে আর শোনে।   গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তোলপাড় হলেও , সন্বিত ফিরবে না সরকারের।
তবে এই মদের দোকান কেন খোলা হল এই রাজ্যে ? সে কথা অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন। যেখানে মানুষের খাবারের যোগাড়ের জন্য যেখানে যেতেই হয় , অধিকাংশ এলাকাতে সেই বাজার বন্ধ,দোকান বন্ধ, পাইস হোটেল বন্ধ আর কত কিছু বন্ধ। কারণ ওখানে মানুষ ভিড় করবে। কিন্তু মদের দোকানে নাকি একেবারে নিয়ম মেনে ফুর্তিবাজরা ফুরতির জন্য মদ কিনছেন সেটা ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। নিরন্ন , হাতে কাজ না  থাকার কারণে ,অর্থহীন মানুষগুলো এসব দেখে কি ভাবছেন, তাদের মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা কেউ কি করেছেন ?
আমাদের সরকারের তরফ থেকে অন্ততঃ এই বিষয়ে একটু মানবিক মুখ আশা করেছিল, রাজ্যের এই মুহূর্তে এক বিশাল সংখ্যার আধপেটা খাওয়া মানুষেরা।
অন্যদিকে কেন হঠাত করে এই মদের দোকান খোলা হল তার কারণ একটু বলে নেওয়া যাক। একমাত্র এই একটি পথ ধরেই রাজ্যের কোষাগারে খুব সহজেই আবগারী দফতর মারফত জমা পড়বে অনেক টাকা। সেটা তো আর সব্জী বা অন্য কোন জায়গা থেকে আসবে না। সারা দেশের একটি রাজস্ব আদায়ের হিসেব দেওয়া যাক। ২০১৮-১৯ সালে সরকারি হিসেব অনুযায়ী এক ধাক্কায় ১৬ শতাংশ রাজস্ব বা কর আদায়ে বৃদ্ধি ঘটেছে এই একটি ক্ষেত্রে। আর কোন সরকারি ক্ষেত্রে ঘটেনি। এর পরিমান শুনলে অবাক হনে, প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ,সরকারি কোষাগারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাহলেই বলুন যেখান থেকে সরকারের এইরকম আয় হবে , সেটা নিয়ে ভাববে , না সাধারণ মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার চেষ্টা কবে, নিরোগ করার চেষ্টা করবে?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours