মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:
 
‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ,’ এমন অহঙ্কারী  কথা যিনি সগর্বে বলতে পারেন তিনি যে প্রখর আত্মসম্মানী  হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বার বার যার গানে, কবিতায় ঝলসে উঠেছে সমাজ , শাসক আর শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তিনি হলেন আমাদের পরম প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার নামের সাথে জুড়ে গেছে বিদ্রোহী কবির তকমা।  ১৩০৬  সালের ১১ই  জৈষ্ঠ ( ইংরেজি ১৮৯৯ এর ২৫শে মে, মতান্তরে ২৪ শে মে) চুরুলিয়ায় যে দামাল শিশুর জন্ম হয়েছিল আজীবন সে তেমনি দামাল আর প্রতিবাদী রয়ে গিয়েছিলেন।
‘ভোর হোল দোর খোল ‘, লিচুচোর ইত্যাদি ছোটদের কবিতা লেখা নরম মনের মানুষটিই আবার ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন তার গানে।  বাংলার যুবসমাজকে আহ্বান করে বলেন, 
’ওরে ও তরুন ঈশান, বাজা তোর প্রলয়  বিষাণ।
 ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী।‘
সেই সময়ে গান, কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি বের করলেন ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় তাঁর অগ্নিঝরা প্রবন্ধ, তৎকালীন আরো কবি,  লেখকদের রাজনৈতিক আলোচনা  ব্রিটিশ শাসকের কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল।একের পর এক প্রতিবাদী কবিতা , গান লিখে তিনি বাংলার যুবসমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। সেই কারণেই ভারতের ব্রিটিশ সরকারের চরম শত্রু  হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে  রাজদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাতেও তিনি দমেননি। জেলে বসেই কয়েদীদের প্রতি ইংরেজদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করলেন।   মৃত্যু পথযাত্রী নজরুলকে বাঁচানোর  তাগিদে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ ব্যক্তিরা আবেদন করলেন। কিন্তু নজরুল তাঁর সঙ্কল্পে অটল। এমনই ছিল তার চারিত্রিক দৃঢ়তা। অবশেষে মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবি মাতৃত্বের দাবীতে কাজী সাহেবের  অনশন ভঙ্গ করান। 
তাঁর প্রতিবাদ কেবল ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধেই ছিল না, অন্তঃসারশুন্য    সমাজ ব্যবস্থার  বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সদা প্রতিবাদী। 
সনাজের পতিতা নারীদের সম্মানে লিখলেন ‘বারাঙ্গনা’ কবিতা। তার প্রতিটি  লাইনে রয়েছে সমাজের মনোভাবের প্রতি তীব্র কশাঘাত।
 ‘কে তোমারে বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও গায়ে? 
হয়ত তোমারে স্তন্য দিয়েছে সীতা সম সতী মায়ে।
নাই হলে সতী  তবু তো তোমরা মাতা ভগিনীর জাতি,  
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি, আমাদেরই কোন বন্ধু স্বজন আত্মীয় বাবা কাকা
ঊহাদের পিতা , উহাদের মুখে মোদেরি  চিনহ আঁকা।‘ 
কি অসম্ভব সাহস  থাকলে  এরকম চোখে আঙুল দিয়ে সত্য দেখানোর স্পর্ধা করা যায়। তিনি পেরেছিলেন কারন তিনি যে কাজী নজরুল ইসলাম। এক জ্বলন্ত প্রতিবাদের নাম। 
 তৎকালীন গোঁড়া সমাজের মর্মমূলে আঘাত করে ভিন্ন ধর্মী হয়েও ভাবে  ভক্তিতে তিনি একের পর এক শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। 
‘হে পার্থ সারথি বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’,  বিদ্রোহী, সব্যসাচী ইত্যাদি বহু রচনাতেই বহুবার হিন্দু দেবদেবীর নামের উল্লেখ করেছেন।
দে গরুর গা ধুইয়ে নামক তীব্র স্যাটায়ার , সাম্যবাদী সিরিজের কবিতা গুলি,  ‘মোরা একই  বৃন্তে দুটি  কুসুম হিন্দু মুসলমান’ এই সব লেখাতে তিনি জাতপাত ধর্মের বিধিনিষেধ ও সঙ্কীর্ণতাকে তীব্র   ব্যাঙ্গের সাথে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন।  যে সময় সমাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদ চরম ছিল সেই সময়ে তিনি লিখলেন-
‘’ সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যানকর 
অর্ধেক তাঁর করিয়াছে নারী অর্ধেক  তার নর।‘
তার এই সব রচনার জন্যে গোঁড়া হিন্দু ও গোঁড়া মুসলমান দুই  সম্প্রদায়েরই চক্ষুশূল ছিলেন । 
তীব্র সমালোচনা তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, শোক, অর্থাভাব তাঁকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁঝরা করেছে, কিন্তু তাঁর আত্মসম্মান ও প্রতিবাদী সত্ত্বাকে কাড়তে পারেনি। 
তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছেন-
‘ আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি , ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।‘ 
কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই কখন যেন বাঙালীর প্রতিবাদের ভাষা , ও আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে গেছেন। 
তাই আমরা আজও  শত বিপদেও মাথা উঁচু করে বলতে পারি-
‘ বল বীর-
চির উন্নত মম শির।‘

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours