প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
"বিদ্রোহী কবি", প্রেমিক কবি; নারী হলো সেই প্রকৃতি প্রেম; " তুমি আরেকটি দিন থাকো, " বঁধু আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখি জলে। "।দ্রোহ ও প্রেমের নিরিখে সাহিত্য পেয়েছে এক অনন্যমাত্রা - 'ভালোবাসি তাই ভালোবাসি। "কবির প্রেম এসেছে বহুবার। এমন শব্দ প্রেমের বন্ধনী মেনেই অনন্য সাহিত্য আধার ; তাই কবি সুরে গাই, " মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য"। দুরন্ত উন্নত শির, তবু কুমারী প্রেমের উদ্দমতা ছুঁয়েই কালি কলম প্রেম। যদি হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের কথা না বলে, যদি ভ্রুণ শব্দ ছুঁয়ে ফুলের আনুগত্য না আসে, যদি ঘাসের প্রলেপে নরম উদাসী বপু স্পর্শ না করে, তবে যে লেখা যায় না, " আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি - সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!" তবে কি সৃষ্টি প্রেম নয়! যাপনে আবেগঘন মন প্রেমের শাশ্বত আবেদন নয়! তবে যে আরতি, " আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।"
বিদ্রোহী কবির চেতনায় স্বর্ণালি জীবনবোধ যে, প্রেমপ্রতীকী, সেখানে কবি সত্তা নিজেই প্রতীকী। জীবনে বহুবার প্রেমের উষ্ণতায় বয়েছেন কবি। জড়ানো প্রেমে বারে বারে এসেছে সুখ,আবার পশ্চাতে অসুখ। সময়টা ১৯২১ ; কুমিল্লার দৌলতপুর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় নার্গিসের সাথে৷ কিন্তু তখন তিনি সৈয়দ আসার খানাম। ভালোবেসে, ভালোবাসায় প্রেম ছুঁয়ে ইরানি এক সাদা গুল্মপুষ্পের নামে কবি প্রেমিকার নাম দিলেন নার্গিস। আর দৌলতপুরেই ভালোবাসার বাগিচায় প্রস্ফুটিত হলো ১২০ টি কবিতা এবং ১৬০ টি গান৷ ভালোবাসার ঘর বেঁধে এলো, " বেদনা অভিমান, " " অনাদৃতা ", " পথিক প্রিয়া ", " বিদায় বেলা " প্রভৃতি।
দীর্ঘ দুইমাসের প্রেমের পর নার্গিসের সাথে অভিমানে পরিণয়ের রাতে কবি নার্গিসকে ত্যাগ করেন। কবি লিখেছেন, নার্গিসের প্রতি তাঁর বিন্দুবিসর্গ জিঘাংসা নেই। তাঁর জন্য রয়েছে অসীম বেদনা আর হৃদয়ে বিশদ ক্ষত। নিজে পুড়েছেন বার বার, কিন্তু প্রেম তো তাঁর কাছে অগ্নিপরশ মানিক, তাই তা দিয়ে নার্গিসকে পোড়ান নি। ভালোবাসার অঞ্জলি যে স্বর্গের পারিজাত, চির অমলিন,সৃষ্টিসুখের যাপন সাকার। দীর্ঘ ১৭ বছরের, স্মৃতির দুঃসহ জ্বালায় রাত কাটিয়েছেন নার্গিস৷ ১৯৩৮ সালে ১২ ই ডিসেম্বর নার্গিস পুনর্বার বিবাহ করেন। কবি কলম কাঠিতে লিখে দিলেন, ", পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা যায় পরাণপ্রিয় ", সাথে চিরকুটে লেখেন, " জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। " তবে কি পাওয়ার আগ্রহটা মনের গহীনে রেখেছিলেন!! এ যাপনের অধিকার কেবল তাঁর।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়৷ বিবাহ আইনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে স্ব স্ব ধর্মপরিচয় বজায় রেখেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রমীলা তখন ১৪ আর কবি নজরুল ২৩। কিন্তু বিরাজমান বৈষম্য ভেদের কোনো আঁচড় তাঁদের দাম্পত্য জীবনে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারেনি৷ তিনি অনেকটাই লুৎফুন্নেসাকে মনে করিয়ে দেন৷ সুখ দুঃখের বোঝা ঠেলে তিনি আজীবন তাঁর জীবন সঙ্গিনী ছিলেন। তাঁদের প্রেমের কথা কবি " বিজয়িনী" তে লেখেন। " দোদুল দুল " কবিতায় তিনি লেখেন, " মৃণালু হাত / নয়ানু পাত / গালের টোল / চিবুক দোল / সকল কাজ / করায় ভুল / প্রিয়ার মোর / কোথায় তুল / কোথায় তুল/কাকঁল ক্ষীণ / মরাল গ্রীব / ভুলায় জড়/ ভুলায় জীব/ গমনু দোল / অতুল তুল।।"
১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে বিশিষ্ট লেখিকা মিস ফজিলতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ এক কিংবদন্তী। কবি নাকি জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন ; প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ রেখেই কবির প্রেম প্রগাঢ় হয়। কিন্তু মিস ফজিলতুন্নেসার মন জয় করা আর হলো না। মোতাহার হোসেনের কাছে কবি মিস ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন৷ কিন্তু
মিস ফজিলতুন্নেসা কবিকে আর চিঠি লিখতে বারণ করেন। কবি কিন্তু অনড়ভাবে প্রকাশ করেন যে, না তিনি আবার চিঠি লিখবেন৷ মিস ফজিলতুন্নেসা " সওগাত " - এর জন্য একটি গল্প লেখেন। কবিকে বলেন, যেন তিনি ঠিক করে দেন। কবি চেয়েছিলেন, মিস ফজিলতুন্নেসাকে তিনি তাঁর " সঞ্চিতা " উৎসর্গ করবেন। কিন্তু মিস ফজিলতুন্নেসা বলেছিলেন, তাঁর লেখা যেমন তিনি তেমনই ছাপাতে চান। এতে কবি আঘাত পান এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। পরে সেই চিঠিগুলি একত্রিত করে সৈয়দ আলী আশরাফ " নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায় " গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
বলা হয় কবি বার বার প্রেমকে যাপন করেছেন, উপলব্ধি করেছেন। প্রেম রেখেছে কখনও সাময়িক উচ্ছ্বাস, আবার কখনও রেখেছে আত্মতৃপ্তি তার।
মিস ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশ্যে কবি লেখেন, " উদিলে চন্দ্র লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে। " সময় তো ক্ষীণ ; উপলক্ষের কবি এঁকে দেন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার চেতনাশ্রিত রূপক। রানু সোম এর সাথে কবির গুরু শিষ্য সম্পর্ক চোখে পড়ে, " কে বিদেশী বন - উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে৷ " জাহানারা বেগমের সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় ১৯৩১ সালে ; জাহানারা বেগমের কাছে কবির ৮ টি কবিতা ও ৭ টি গান সমন্বিত একটি খাতা ছিলো। নজরুলের জীবনকালে এগুলি অপ্রকাশিত ছিল। জাহানারা বেগম চৌধুরী মৃত্যুর আগে এগুলো প্রকাশের অনুমতি দেন।
শিল্পী কানন দেবীকেও কবি গান শিখিয়েছিলেন। ব্যথার দান গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন, " মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা
করোনি,তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করলুম। "
কবিমানস জুড়েই আছে প্রেম। প্রেম ঝড়ে গেছে নিভৃতে, তবু সত্য সুন্দরের পূজারী করে শব্দ যাপন। সুরের বেহাগে আলাপ, অনন্য অনুভূতির অঙ্গনে ভালোবাসারা। সত্য, সুন্দরে সৌন্দর্য জুড়েই স্বপ্নপুরীর খোঁজ। তাই অবশেষে প্রেমের পাতায় আলাপ লিখে যায়, " আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।"
তথ্যঋণ -
#নজরুল কাব্যগ্রন্থ
# বহুমাত্রিক নজরুল
#"ইসলাম, কাজী নজরুল ", রফিকুল ইসলাম
#নজরুল চরিত মানুষ
#নজরুল জীবনের নারী ও প্রেম ;
ডঃ আবুল আজাদ
#কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা
Post A Comment:
0 comments so far,add yours