প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি নারী "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী "। কিন্তু লিকাই, অভিশপ্ত ঈর্ষায় বলি আজ৷ 

আসুন আজ লিকাইয়ের কথা বলার আগে তাঁর সম্প্রদায়ের কথা জেনে নিই। খাসিয়া সম্প্রদায় বললেই মনে পড়ে যায় ভারতের মিজোরাম বারো মেঘালয় রাজ্যের কথা।  প্রচলিত মত বলে, এরা নাকি অনার্য। অধিকাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ৷ এরা সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত৷ এরা মাতৃতান্ত্রিক নৃগোষ্ঠী৷ খর্বাকার, গাত্রবর্ণ হরিদ্রাভ, নাক মুখ চ্যাপ্টা, চোয়াল উঁচু, কালো টানা টানা খর্বাকার চোখ বিশিষ্ট। এরা আসামে এসেছিল সম্ভবত তিব্বত থেকে। গারো -  খাসিয়া - জয়ন্তিয়ার পাহাড়ি পরিবেশ এদের পছন্দ৷ পাহাড় টিলা, ঝোপজঙ্গল জুড়ে কাঠ ও বাঁশের মঞ্চের উপর কুঁড়ে ঘরেই এদের বাস। খাসিয়ারা গ্রামকে বলে পুঞ্জি। 

এই খাসিয়া সমাজ মাতৃতান্ত্রিক পরিবার৷ সিলেট অঞ্চলেই এদের বর্তমান বসবাস৷ অরণ্যে পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করাই এদের কাজ।সবটুকু সাংসারিক নিয়ন্ত্রণে থাকেন নারীরা। নারীরা কনে যাত্রী নিয়ে নিজেদের পুঞ্জিতে বর নিয়ে আসে। এরা নিজস্ব নিয়মের দাস৷ স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক এই নারীরা৷ স্ত্রীর বাড়িতেই বরেরা জীবন কাটায়। এদের স্ত্রীরা কখনই বরের ঘরে থাকে না৷ মায়ের বংশপরিচয়ে শিশুরা বড়ো হয়৷ এরা স্বগোত্রে বিবাহ করে না৷ এদের ৪ / ৫ জন একসাথে মেয়ের বাড়িতে থাকে। বিয়ে বা পুজোতে মেয়েরাই অংশগ্রহণ করে৷ এদের বিশ্বাস" উব্লাই নাথউ " ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা৷ 

এমনই এক মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে লিকাই এর বাস৷ লিকাইয়ের খুব কম বয়সে বিয়ে হয়৷ লিকাই কম বয়সেই এক কন্য সন্তানকে জন্ম দেয়। কিন্তু এক বর্ষায় সাপের ছোবলে লিকাইয়ের স্বামীর মৃত্যু হয়। ১৯ বছরের বিধবার এবার সংগ্রামের জীবন। মহাজনদের কাঠ কেটে তা মালবাহকের কাজ করতো লিকাই৷ সবুজ ঘাসের প্রলেপে তুলি আঁকা পুঞ্জে মায়াবী ঝরণায় লিকাই সবসময় মুখর৷ প্রতিবেশীর কাছে মেয়েকে রেখেই সে কাজে যেতো। মায়ের মন, সে কেঁদে ফেলতো; তবু সেই মেয়ের মুখ মনে করতে করতেই তার দিনাতিপাত হতো৷ সারাদিনের শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে কোলে নিয়ে, চুমু দিয়ে তার সোহাগ উজাড় করে দেয় অভাগী মা।

 এইবার একদিন সেই গ্রামের এক ছেলে লিকাইয়ের প্রেমে পড়ে৷ জীবনের বুকে বাজ পড়তে দেখেছে লিকাই, তাই সাড়া দিতো না৷ সে লিকাইকে বোঝায় যে তার একমাত্র মেয়ের বাবা প্রয়োজন৷ লিকাই এবার আরক্ত হয়েই জীবনের ভাষা খুঁজতে মানুষটিকে ভালোবেসে ফেলে৷ স্বপ্নের বুকে মাথা রেখেই তো প্রেমের প্রথম  স্তরে এগোয়। 
লিকাই বিবাহ করে৷ ভালোবাসার একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে লিকাই ছেলেটিকে বিবাহ করে বাড়িতে আসে৷ লিকাই তার আদরের দুলালীকে দ্বিতীয় স্বামীর কাছে রেখে চলে যায়। স্বামী মেয়েটিকে দেখাশুনো করতে থাকে। শুধু শিকারের মুহুর্তে সে শিশুটিকে প্রতিবেশীদের কাছে রেখে যায়৷ সারাদিনের কর্মক্লান্তি পরে  বাড়ি ফিরেই মেয়েটিকে লিকাই কোলে নেয়। আদর করে, জলে কাপড় ভিজিয়ে স্নান করিয়ে দেয়। এদিকে সময়ের মুহুর্তে লিকাইকে কাছে না পেয়ে দ্বিতীয় স্বামী খেপে ওঠে। একরত্তি মেয়ে মাকে পেলে মাকে ছাড়তেই চায় না৷ আর স্বামীর সব ক্ষোভ শিশুটির উপর এসে পড়ে। সে লিকাই চলে গেলেই শিশুটির উপর অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে৷ 

প্রতিদিন লিকাই দেখতো শিশুটির চোখের নীচে জলের দাগ৷ না খেয়ে শুকিয়ে যাওয়া মরা লাশের মতো চেহারা, লিকাইকে ভয় ধরিয়ে দেয়। মেয়েটি ভয়ে চুপ থাকে। একদিন লিকাই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসে। সূর্য তখনও ডোবে নি৷ লিকাই ফিরতেই তার দ্বিতীয় স্বামী তার হাতে একটি মাংসের থালা ধরিয়ে দেয়৷ প্রথমে মেয়ের কথা ভাবে যে, হয়তো স্বামী রান্না করছিলো, তাই শিশুটিকে প্রতিবেশীদের কাছে দিয়ে এসেছে৷ এই ভাবতে ভাবতে লিকাই গোগ্রাসে প্লেটের মাংস খেয়ে ফেলে। স্বামী নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়৷ লিকাই রোজকারের মতো পান সাজে ও মুখেপুরতেই দেখে যে, পানের বোঁটার পাশে তার মেয়ের আঙুল কাটা পড়ে আছে৷ এটা যে সেই মেয়েটির, সেই কথা বুঝতে তার এক মুহুর্ত লাগে না। লিকাইয়ের চোখের সামনে ঘটনা ভেসে ওঠে। পাগলের মতো সে ঘর ছেড়ে জঙ্গলের পথ বেয়ে ছুটতে থাকে৷ এই রাক্ষুসে অভিশাপের মাংস যে তার মেয়ের এটা সে নিতে পারে না। " আমি আসছি মা...."   বলে লিকাই দুইহাত বাড়িয়ে ঝরনার খাদে ঝাঁপ দেয়৷ সে মুহুর্তে সে ১১১৫ ফুট নীচে চলে যায়। তার নামেই ঝরনার নাম হয় "নোহকালিকাই"। 

মা তো মা হন। শিশু আর মায়ের স্বপ্ন আকাশে রং পায়। আর কোনো ঈর্ষা নয়, আর কোনো বাঁধা নয়, আজ মুক্ত পৃথিবী আবার৷ অনেকে বলেন, ওই ছোট্ট নদীটিতেই শিশুটি লুকিয়ে আছে, আজও। ভালোবাসার একবুক নদী সাকার।

(তথ্যঋণ-উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যম ও খাসিয়া নৃ গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সম্পর্কিত কিছু নথি) 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours