দেবলীনা গুপ্ত, অ্যাসোশিয়েট প্রফেসর ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

জনসাধারণের মনের মধ্যে শুধু নানান ভয়ের অনুভূতি—মৃত্যুভয়, কাজ হারানোর ভয়, না খেতে পাওয়ার ভয়, দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়ার ভয়।

দেশ পরিচালনা করছেন যাঁরা তাদের আবার আরেকটি উপরি ভয় ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি হারানোর ভয়। ফলে যেমন কোভিড মহামারী সারা দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, বুদ্ধিভ্রংশের মত অসুখ ও এঁদের তেমনই তাড়া করে বেড়াচ্ছে, ফলে সব সব (রাজ্য ও কেন্দ্র) সরকারের নীতিতে এত অসামঞ্জস্য, হৃদয়হীণতা আর পরিণতবোধের অভাব, কখন কোন নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে তা না বুঝতে পেরে একের পর এক বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ, যা গোটা দেশে বিপর্যয় আনতে চলেছে।

আসি দেশে গণস্বাস্থ্য আর উৎপাদনের কথায়। যে কোনো অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভ যে শ্রমিক সমাজ তাঁদের নিয়ে যে কি প্রহসন চলছে, তা চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠেছে।

এদেশে শ্রমিকের বড় অংশই হলো অসংগঠিত শ্রমিক, যাদের মধ্যে আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক। এঁরা কাজের খোঁজে ছুটে বেড়ান এক শহর থেকে আরেক শহরে বা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতে নিজেদের পরিবারে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারেন। কখনো একা বা কখনো সমগ্র পরিবারকে সঙ্গী করে নিজেদের সব ছেড়ে রোজগারের আশায় বেড়িয়ে পড়েন নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে।

এঁদের কাজের, থাকার পরিবেশ আর জীবনযাপণের দৈণ্যতা নিয়ে বোধহয় আলোচনা না করাই মঙ্গল। কিছুটা সংঘবদ্ধভাবে থাকলেও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন নানা বিপদের আশংকায়- কাজ চলে যাওয়ার, প্রাপ্য মজুরী না পাওয়ার, অস্থায়ী বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের, সর্বোপরি রাজনৈতিক চেলাদের উৎপীড়ণের।

বর্তমান পরিস্থিতির দিকে চোখ ফেরানো যাক। এদেশে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আগে এঁরা ছিলেন নিজের নিজের কাজের জায়গায়, নানারকম চুক্তির ভিত্তিতে। ভারতে যখন লক্-ডাউন শুরু হলো তখন এই সব শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও, নিজেদের স্বল্প জমানো টাকা দিয়ে কয়েকদিন কোনোরকমে খেয়ে পড়ে কাটিয়ে দিতে পারবেন ভেবে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন। ভেবেছিলেন লক্-ডাউন কদিন পরে উঠলেই তো মিলবে কাজ এবং হয়তো আগের পাওনা গন্ডা।

তাঁদের পক্ষে এই মহামারীর ব্যপকতা এবং একে কাবু করতে গেলে সূদীর্ঘ সময় ধরে লক্ ডাউনের ব্যাপারে কোনো ধারনা করা সম্ভব ছিল না তাই যতই লক্-ডাউনের সময়সীমা বাড়তে লাগলো, কয়েকদিনের মধ্যেই হাতের পূজি ফুরিয়ে যাওয়া, দু-মুঠো খাবার না জোটাতে পারা, বকেয়া বাড়ী ভাড়ার তাগিদা-এই শ্রমিকদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুললো। কিন্তু সরকারপক্ষ, নিয়োগকারী বা অন্য কোনো মধ্যস্ততাকারী সংস্থা এদের সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা তো নিলোই না বরং চোখ কান বন্ধ করে থাকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই দেখা গেলো। অথচ ঠিক এই সময়ে এদের কিছুটা অর্থসাহায্য, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা আর নুন্যতম রেশনের ব্যবস্থা করা গেলে আজ এই অরাজকতা আর কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টিই হোতো না। দরকার ছিলো একটু আশ্বাস, সহানুভূতি আর উড়ো খবর ছড়ানোর প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়া।
হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়ানো কিংবা রাস্তা ঘাটে গাড়ী, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রচারসর্বস্ব ছুটে বেড়ানোর জন্য যত টাকা খরচ হলো, সেটা কি শ্রমিকদের জন্য ব্যায় করা খুবই অবাস্তব বা কষ্টসাধ্য ছিলো? এই মানুষগুলিকে সরকারপক্ষের কিংবা মালিকপক্ষের তরফ থেকে কিছুটা সহায়তা মিললে, কষ্ট করেও এরা নিজেদের কাজের জায়গায় থেকে যেতে পারতেন, ফিরে আসার পর চর্তুদিকে সংক্রমণ ছড়ানোর মত পরিস্থিতির উদ্ভবই হোতো না। লক্-ডাউনের বিধি নিষেধ ধীরে ধীরে শিথিল হলেই এঁদের আবার উৎপাদনের কাজে ফিরিয়ে আনা হোতো, অর্থনীতির চাকাটি সচল করার কাজ হয়তো কিছুটা সহজ হোতো। কিন্তু এই শুভবুদ্ধির উদয় তখন হোলোই না।

এক দেড় মাস ধরে এই শ্রমিকেরা সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, অধৈর্য্য হয়ে নিজেদের আদি বাসস্থানে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠলেন তখন বোধহয় সকল পক্ষের বোধোদয় হোলো। কিন্তু তার আগে থেকে শুরু হয়েছে শ্রমিকদের হেঁটে বা ভাড়া করা যানবাহনে কোনরকমে বাড়ী পৌঁছানের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা- যার পরিণতি যন্ত্রণার নানারকম হৃদয়বিদারক আখ্যান আর প্রতিদিনের মৃত্যু মিছিল।

তুঘলকী ব্যবস্থায় শুরু হলো আরেক নাটক- শ্রমিক ট্রেন চালু করে শয়ে শয়ে শ্রমিককে তাদের রাজ্যে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ। এঁদের মধ্যে কারা সংক্রমিত, কাদের মধ্যে সুপ্ত রোগ লক্ষণ রয়েছে, এদের ফেরার পরে সমস্ত রাজ্যে এদের মাধ্যমে কত দ্রুত, ব্যপক সংক্রমণ ছড়াতে পারে, সে ভাবনার প্রয়োজন রইলো না। ভোট ব্যাংকের তাগিদে রাজ্যের প্রধানরা এগিয়ে এলেন এদের বুকে তুলে নিতে, দায়সারা থার্মাল স্ক্রিনিং এর হাস্যকর ব্যবস্থাপনা, জলের বোতল আর খাবারের প্যাকেট হাতে ছবি তোলার হিড়িকে, হারিয়ে গেলো স্বাস্থ্য রক্ষার নূন্যতম নিয়মগুলি। সরকারী কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা অপ্রতুল এবং সেখানেও ভয়ংকর অব্যবস্থা- ফলে দাওয়াই হোলো হোমকোয়ারেন্টাইন। যাঁদের এগুলি বলা হোলো তাঁরা না বুঝলেন এর গুরুত্ব, না মানলেন সরকারের প্রস্তাবিত বিধিনিষেধ। ফলে রোগ ছড়ালো দেশের সব প্রান্তে, বিশেষ করে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরে আসার পর থেকে সকলেই দেখছেন যে সংক্রমণ কিভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কেননা এঁদের অনেকেই কোভিড আক্রান্ত। বর্তমানে ভারতে এই মুহূর্তে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০৬৭৬০, মৃত প্রায় ৩৫০০। এইভাবে হয়তো পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে না কেননা প্রতিদিন সংখ্যাগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যদি আরো বেশী সংখ্যায় পরীক্ষা হোতো অন্য দেশের মতো তাহলে আক্রান্ত আর মৃতের হিসাব যে কি দাঁড়াতো কেউ জানেনা।

অন্য দেশের তুলনায় ভারতের কোভিড ভাইরাসটির মারণক্ষমতা হয়তো অপেক্ষাকৃত কম তবুও দিনে দিনে আরো কতজন সংক্রামিত হবেন, এখন থেকে কিছুই বলা সম্ভব নয়। যারা নিজের জায়গায় ফিরে এলেন, তাঁরা সেখানে কোনো কাজ পাবেন কিনা, খাবার জুটবে কিনা আবার পুরোনো কাজের জায়গায় আদৌ ফিরে যেতে পারবেন কিনা- সবই অনিশ্চিত আর হেঁয়ালীতে ভরা। আবার যেখানে যেখানে উৎপাদন বা অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজকর্ম শুরু হওয়ার কথা, তার জন্যে যথেষ্ট পরিমানে উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন লোক এত দ্রুত পাওয়া যাবে কিনা তার ও কোনো নিশ্চয়তা নেই ফলে বাড়বে মহামারীর প্রকোপ, দারিদ্র কর্মহীণতা, আর উৎপাদনের স্বল্পতা, ধুঁকবে অর্থব্যবস্থা- এই সব অন্যায়ের দায় কার? সরকারী প্রতিনিধি, মন্ত্রী, আমলা সবাই মিলে সাংবাদিক বৈঠক করে সংখ্যার কারসাজিতে জনসাধারণকে এমন হতভম্ব করে রাখেন যে প্রশ্ন তোলার, উত্তর দাবী করা- সাহস শক্তি কারোই থাকেনা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours