প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
কাঁকড়া", শব্দটির সাথে অনেকক্ষেত্রেই চন্দ্রবিন্দু যোগ থাকে না, আবার রাঢ় বাংলায় এই চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ কথ্যভাষায় চোখে পড়ে। কাঁকড়া বললেই  বড়ো আকারে পুরু বহিঃকঙ্কাল বিশিষ্ট ক্রাস্টারিয়া প্রাণীকেই বোঝায়। তবে সেটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক কথা। সাধারণ ভাবে প্রজাতি বললে ৬,৭৯৩ টির সন্ধান পাওয়া যায়।মিঠে জল ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় পরিবেশে কিছু স্থলবাসী কাঁকড়া পাওয়া যায়। "The world of Animals " এ কাঁকড়াকে আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণী বলা হয়েছে। এদের নাকি চিংড়ির সাথে বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান। ছোটো ছোটো যে কাঁকড়া বাজারে দেখা যায় তা নদীর পার বরাবর অসংখ্য একত্রিত বসবাস চোখে পড়ে৷ পূর্ণিমার রাতে নদীর জলে পূর্ণাঙ্গ ভাবে কাঁকড়াকে  ভাসতে দেখা যায়৷  রসালো রেসিপির মানুষের কাছে কাঁকড়া মাথা ফাটিয়ে খোলসের  ভিতরে থাকা হলুদ তরল ঘিলু  একত্রিত করে তা দিয়ে তেলে ভেজে  বড়া করলে দারুণ লাগে৷ অনেকেই সন্নাসী কাঁকড়া ভীষণ পছন্দ করেন৷ নরম তলপেটের অধিকারী এই কাঁকড়া পরিণত হলে নিজেই নিজের প্রয়োজনের অপেক্ষাকৃত বৃহৎ খোলস খুঁজে নেয়।

 শোনা যায় যে তন্ত্র পদ্ধতি এমন অনেক সন্ন্যাসী আছেন, যাঁরা উন্নিত পর্যায়ে আর মাতৃগর্ভে নিজেকে ধরে রাখেন না৷ অচল শরীরকে নিজের ইচ্ছামতো বদল করে, নতুন দেহ খুঁজে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেন। শরীরটা খোলস, তাই তাকে ছাড়তেই হয়। প্রয়োজনে দেহ যাক, কিন্তু সাধনা যেন উপযুক্ত বহরে প্রকাশিত হতে পারে, তাই বাকল পরিবর্তন৷ অনুরূপে এই জাতীয় কাঁকড়ারা বার বার নিজের উপযুক্ত বাকলে নিজেকে যথোপযুক্ত করে নেয়। তাই এই ধরনের নাম রাখা হয়।তবে এই জাতীয় কাঁকড়া বসবাসের জন্য উপযুক্ত গভীরতা খুঁজে নেয়। এমনকি ক্রান্তীয় অঞ্চলে শুকনো মাটিতে এই প্রজাতির কাঁকড়া বসবাস করে। তবে এরা আকারে বৃহৎ হয়। তথ্য জানলে বোঝা যায় যে, প্রকৃতিও একজন সাধিকা স্বরূপ। 

কাঁকড়া আমদানী অপেক্ষা রপ্তানি আজ নজর কাড়ে৷ কৃষি ও কৃষ্টিতে লবণাক্ত ও সাধু জল মিশিয়ে সাধারণ ভাবে  ১৫ প্রজাতির বেশী  কাঁকড়া পাওয়া  যায়। পরিসংখ্যান বলতে প্রায় ১৬ কোটি টাকার বেশী বিদেশী রপ্তানি করা হয়; তাই কাঁকড়া যে জলজ প্রাণী হিসাবে নজর কাড়বে এটা বলার আবশ্যিকতা থাকে না। বাণিজ্যিক ভাবে কাঁকড়া বলতে ম্যাট, ক্যাট বা শিলা কাঁকড়া।সুন্দরবন অঞ্চলে এই জাতীয় কাঁকড়া চোখে পড়ার মতো।এছাড়া বহু রঙের কাঁকড়া ধরা পড়ে। এমনকি স্ত্রী কাঁকড়ার ডিম বর্তমানে এতটাই চাহিদা পূর্ণ, যে,  বাচ্চা হওয়ার আগেই এইগুলি শিকারীদের হাতে চলে যায়। 

তবে বাংলাদেশে এবং  প্রান্তীয় অঞ্চলের বহু মানুষের একটা বড়ো অংশ এই ব্যবসার সাথে যুক্ত। কিন্তু কেমন হয় এই চাষ। শ্যামনগর, সাতকিয়ায় এই কাঁকড়ার খামার দেখতে পাওয়া যায়। পরিসংখ্যান বলছে,   শ্যামনগর উপজেলায় ১,০২৪ টি খামার বিদ্যমান৷ এর মধ্যে বাণিজ্যিক খামার ৩৯ টি এবং এই খামারের আয়তন ৪৯ হেক্টর। সেখানে উৎপাদন বছরে ২০ টন। ৯৮০ টা মতো সনাতন খামারে দুই টন অথবা তিন টন  চাষ হয়। একত্রে তিনরকম টেকনোলজি নিয়ে কাজ করা হয়। এক কিশোর কাঁকড়া চাষ, দুই পেনে কাঁকড়া চাষ ও তিন হলো খাঁচায় কাঁকড়া চাষ। পেন ও খাঁচায় যে চাষ হয় তা বেশ লাভদায়ক হয়। নতুন সংযোজন হলো কিশোর কাঁকড়া চাষ। প্রতি বছর একই পরিমাণ কাঁকড়া পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে সুন্দরবনের উপর নির্ভর করতে হয়৷ আর এই কিশোর কাঁকড়া থাকলে সারাবছর জোগান দেওয়াটা সম্ভব হয়। 
কিশোর কাঁকড়া চাষে প্রতি হেক্টরে এক থেকে দুই লক্ষ টাক পর্যন্ত আয় হয়৷ খাঁচার ক্ষেত্রে নরম পুরুষ কাঁকড়াকে শক্ত করে রাখা হয়। এছাড়া পেনে ১৭০ গ্রাম ওজন পর্যন্ত কাঁকড়া চাষ করা সম্ভব হয়। একদিন বাদে একদিন এই কাঁকড়ার খাবার দেওয়া হয়। তাতে প্রতি কেজিতে মাছ ও বাজার খরচ দিয়ে ৩০ টাকা করে বাড়ে। যদি ৪৩০ টাকা  কাঁকড়া কিলো আসে, সেক্ষেত্রে ৮০০ টাকা কিলো বিক্রি হয় এবং প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হয়। খাঁচায় কাঁকড়া চাষ বজায় রাখতে  বাঁশ, পাইপ, জটা ইত্যাদি সংগ্রহ করে ৪৮ ইঞ্চি গ্যাপে রাখতে হয়। 

এবার যেখানে চাষ হবে, সেখানের জল শুকাতে হবে এবং প্রতি এক শতাংশ হিসাবে  এ কেজি জোন শুকিয়ে দিতে হবে। আবার ৭ দিন পর জল ভর্তি করতে হবে। এরপর প্রতিদিন নয়, তবে কাঁকড়ার উপযুক্ত খাদ্য হিসাবে ছোটো মাছ ও বড়ো মাছের টুকরো খাবার হিসাবে দিতে হবে৷ অধিক তাপমাত্রায়  
কাঁকড়া মারা যায়। মে জুন মাসে অধিক তাপমাত্রায়  খাঁচায় বার বার জল দিতে হয়, এতে মৃত্যু হার অনেক কমে যায়৷ তবে কাঁকড়া চাষে একটি চ্যালেঞ্জ হলো উপকূলে বৃষ্টি কম হওয়ার সাথে সাথে জল লবণাক্ত হয়ে ওঠে,প্রায় ২৪ থেকে ২৫ হয়ে ওঠে। । তাতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ মারা যায়৷ তখন জলকে পরীক্ষা করতে হয়, এবং সংযোজন বিয়োজনের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। 

কাঁকড়ার পলায়নকারী মনোবৃত্তির  জন্য ১.৫ মিটার উচ্চতায় পাটা দিয়ে পুকুরের চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়৷ বাঁশের পাটা প্রায় আধা মিটার পুকুরের চারপাশে মাটির নীচে পুঁতে ফেলা হয়৷ মাটির পি এইচ দেখেই পাথুরে চুন গুঁড়ো করে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এবার জোয়ারের জল তুলে ৭ দিন পর জৈব সারও প্রয়োগ করা হয়। তার তিন দিন পর ইউরিয়া ও টি এস পি প্রয়োগ করা হয়। অজৈব সার প্রয়োগের তিন চার দিন পরে কাঁকড়া মজুত করা হয়৷ 

কাঁকড়া চাষের প্রধান সুবিধাগুলো হলো - 

#উপকূলীয় স্থান কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে উপযুক্ত 
# কাঁকড়ার খাবার স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। 
#ওজন হিসাবে কাঁকড়ার বাড়তি হার বেশী। 
# কাঁকড়া প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেয়। 
# প্রতিকূল পরিবেশ কাঁকড়া অনেকক্ষণ সহ্য করতে পারে। 
# কাঁকড়া পচা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে বিশুদ্ধ করে৷ 

বাণিজ্যিক কাঁকড়ার ক্ষেত্রে ধোপা পদ্ধতি খুব প্রযোজ্য।  নেটের নীচে ভারি কিছু দিয়ে খাবার রাখলেই কাঁকড়া ধরা দেয়৷ পরে রেটিং বা গ্রেডিং  করে পুরুষ কাঁকড়া ও স্ত্রী কাঁকড়া আলাদা করা হয়। স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে ডিম বা বাচ্চা বুকের কাছে  রাখার জায়গা থাকে। এ দেখেই স্ত্রী কাঁকড়া ও পুরুষ কাঁকড়া বোঝা যায়৷  আলোর বিপরীতে উপযুক্ত গোনাড পরীক্ষা করে তবেই উপযুক্ত বাজার তৈরি হয়৷  

সাধারণের কাছে গেঁড়ি, গুগলির সাথে কাঁকড়া এক সুস্বাদু খাদ্য। সুন্দরবন বিদেশীদের কাছে উপাদেয় কাঁকড়া হাতে দিলেও, ৫৫ বছর আগেই হারিয়ে যাওয়া অশ্বক্ষুরের মতো দেখতে বৃত্তাকার রাজ কাঁকড়া কিন্তু আজও বিরল। একে কাঁকড়া বললেও, প্রজাতিগত দিক থেকে এটি সাথে  মাকড়সার  মিল বিদ্যমান। এদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়। এই রাজ কাঁকড়ার ৪৪ কোটি ৫০ লক্ষ আগেও পৃথিবীতে  অস্তিত্ব ছিলো। ডায়নোসরের আগে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে এই প্রজাতি পৃথিবীতে এসেছিলো। এরা সামুদ্রিক লিমুলিডি গোত্রের অন্তর্গত সন্ধিপদী। সাধারাণত অগভীর সমুদ্র ও নরম বালি বা কাদা সম্বৃদ্ধ সমুদ্রতলে বাস করে।

 কালেভদ্রে এরা যৌনসঙ্গমের জন্য ডাঙায় আসে। সাধারণ ভাবে বসন্তের দিকে পুরুষ কাঁকড়ারা জলের গভীরতা ছেড়ে স্ত্রী কাঁকড়ার সংগমে আসে। স্ত্রী কাঁকড়া শরীর থেকে ফেরোমোন নামক রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে পুরুষকে আকর্ষণ করে। স্ত্রী কাঁকড়া একসাথে দশ হাজার মতো ডিম পাড়ে।  চাষের কাজে সার হিসাবে ও মাছ ধরার টোপ হিসাবে  এদের ব্যবহার আছে। সাম্প্রতিক উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে চাষের কারণে ও জাপানে এদের বাস ভূমি ভেঙে যাওয়ায়, তা এখন দেখা যাচ্ছে। এই কাঁকড়ার নীল রক্ত বহু মূল্যবান। এই রক্ত যেকোনো রকম ব্যক্টেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম৷ তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। 

তবে শুধু বিবরণ দিয়েই ছেড়ে দি কেমন করে!  ইতিহাস বলে, হাওড়া উদয়নারায়ণপুর ব্লকের সিংটি গ্রামে ভাই খাঁ পীরের পুজো হয়। এই পুজোয় জিলাপি, পাঁপড়, কাঁকড়া প্রচুর বিক্রি হয়। এই খাঁ পীর আরব থেকে এসেছিলেন। তাঁর সাথে জনগণের সক্ষতা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, তাঁর মৃত্যুতে প্রচুর লোক মেলা করে এসেছিলেন। তারপর থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় এই মেলা।ক্যানিং থেকে কাঁকড়ার পশরা  সাজিয়েই অনেকে এখানে আসেন। তাই উৎসবে এর জুড়ে মেলা ভার৷ 

এবার বলবো জাপানি স্পাইডার ক্রাবের কথা৷ কিম্ভুতকিমাকার এই প্রাণীটি ১০০ বছর বাঁচতে পারে৷ শরীরটি ১২ ইঞ্চি হলেও, পা গুলি বহু বাড়তে পারে৷ এক একটি পা ১২ ফুটেরও বেশী লম্বা হয়৷ এদের ওজন প্রায় ২০ কেজির সমান। জাপানের দক্ষিণ উপকূলীয় স্থানে এই দানব কাঁকড়া দেখা যায়। এরা মাংসাশী। এরা অনেকবারই চিমটের মতো পা দিয়ে জেলেদের আঙুল আলাদা করে দিয়েছে, এ খবরও পাওয়া যায়। তবে এরা ছোটো খাটো উদ্ভিদ ও শ্যাওলা খায়। এরা সর্ব্বোচ্চ তিনটি পা হারিয়ে বাঁচতে পারে। তবে মনুষ্য প্রজাতির হাতে পড়ে এরা অনেকটাই বিলুপ্ত প্রায়। 

জাপানে এমন কিছু নথি আছে যা সত্যিই ভাবায়। শীতের মরশুম হলো খাবার মরশুম। এই মরশুমে প্রায় এক একটি স্নো ক্রাব ৩২ লক্ষ ৬১হাজার টাকায়  নিলাম ওঠে৷ সত্যিই বিশ্ব কতো কিছু দেখায় আমাদের। প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট  ছোট্ট রাক্ষুসে কাঁকড়া পাওয়া যায়৷ এরা নারকেল মাটিতে পড়তেই নারকেল ছাড়িয়ে ফেলে৷ এরপর নারকেলের চোখ খুলে শুষে নেয়৷ এমনকি এদের চর্বি থেকে তেল পাওয়া যায়। এদের দাঁড়ের এক আঘাতে মানুষের হাড় ভাঙতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র স্বাদের কাছে হার মেনে মানুষ একে ধরতে ছাড়ে না। বলাবহুল্য শ্বেতশুভ্র কাঁকড়া মাকড়শাই তেলেঙ্গার ম্যাসকট৷
আরো অনেক কিছু বাকি থেকে যায়৷ প্রজাতির গুণাবলী সামনে এলেই বিস্তৃত হয় আলোচনা। তবু প্রচেষ্টার সামান্য নিবেদন৷  তাই সাধারণী ভেবে নয়, জলজ সম্পদের মূল্যায়ন করেই এই কাঁকড়ার যথার্থতা। 

তথ্যসূত্র - ইন্টারনেট

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours