প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানোৎপাদনকে  সুনিশ্চিত করতে চান। গুণবতী অপেক্ষা শত সন্তানের জননী গড়ে দেবে, সেটাই তো শ্রেয়। কারণ প্র‍য়োজন, অপ্রয়োজন, বিভেদ,  ইপ্সা সবকিছুর কাল পাত্র ভেবে রাজবংশের ধারাকে ফল্গুর পরিণতিতে পর্যবেশিত করবে এমনটা তো ভাবাই যায় না। অজানা ভবির কাছে নবী হয়ে বসে থাকা ছাড়া গান্ধারীর কিই বা আছে!  নির্বাক, নিশ্চলের মতো খামখেয়ালীপনায় সে নিয়তির ক্রিয়ানক।

 শকুনি কি তবে চেষ্টা করেন নি!  করেছিলেন,  হ্যাঁ,বিশ্বাস করা খুব কঠিন। ইতিহাস বলে, আজীবন অগ্নিবলয়ে বন্দী থাকবে এটা তো অগ্নিস্নান, শকুনি চিন্তা করবে নিশ্চয় গান্ধারের ভবিষ্যৎ। তিনি গান্ধারীর চিন্তার মূল্য দেবেন কেন?  কবেই বা অবস্থার বলি হতে নারী বেঁচেছে, যে আজ বাঁচবে!  গান্ধারের অক্ষত সুরক্ষা সে দেবে, রাজী হলেন গান্ধারী৷ আজ রাজা সুবল ক্লান্ত, অবসন্ন, ঋণী।  পুত্র, কন্যা ঋণী হয়, কিন্তু পিতা!  একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে।  পশমের গালিচা সিক্ত হয়৷ আঘাত তীব্র হলে তাকে স্পর্শ করার অনুভব হারিয়ে যায়৷ ক্রোধ, ঘৃণা, যন্ত্রণা, প্রেম কিছুই অনুভবের নয়।

  ভীষ্ম এসেছেন গান্ধারে৷ সাদরে আগলে নিয়েছেন রাজা সুবল।  গান্ধারী চলে যাবেন বলে, শকুনির জন্মদিনের উপহারে নিজের হাতে সাজানো বাগান দিয়ে দিলেন। ফুল তো সেই নারী, ঝরে যাচ্ছে সমাজের যূপকাষ্ঠে৷ অনুরোধের বাঁধনে কিই বা হবে বৈভব রেখে৷ সময়ের মুখে শকুনি সেদিন হাসার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, মনুষত্ব বলেছিলো, পরাজয়ের, অবমাননার দুর্ভাগ্য প্রতিহত হয় নি, তবু কৃতজ্ঞতার হাসি  যে প্রস্তুত করতেই হয়৷ 

শকুনি পানপাত্রে এবার সাজিয়ে ফেলছে গুটি। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ কিন্তু তাই বলে অঘটনঘটনপটিয়সী শকুনি তো নির্মল হয়ে গান্ধারীকে সঁপে দিতে পারেন না৷ সত্যবতী তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করলে তিনি সত্যবতীর সাথে বন্ধুত্ব করেন। অনিচ্ছা থাকলেও পাণ্ডুর সাথে প্রমোদে লিপ্ত হয়েছেন৷ জেনে নিয়েছেন পাণ্ডু চায় না এই সাম্রাজ্যপাট। সে যে শিকার পছন্দ করে, এটা বলায় শকুনি সুখী হয়। পরিহাসের বুকে সৌবল শকুনি খুঁজে নিলেন প্রিয়তমা ভগিনীর ভবিষ্যৎ।  দুঃখের সাগর হারিয়ে গেলো, আনন্দস্রোতের সন্ধান ফিরে পেলেন। 
বিরল রত্নালংকারে  বধূসাজে গান্ধারী। মনোহর
 বিবাহমণ্ডপ এঁকে এবার শুরু হলো বিবাহবাসর। উপহার দিলেন শকুনি এক বিশেষ রত্ন। কোথা থেকে পেয়েছিলেন তিনি!!  হিন্দুকুশ এক বিশেষ খনি থেকে প্রতি দ্বাদশ বৎসর অন্তর একটিবার আহরণ হয়েছিল ; সাজিয়ে রাখলেন গান্ধারী। শকুনির হাত ধরেই উন্মুক্ত বাতায়নে গান্ধারীর বিবাহ মন্ডপে গেছিলেন৷ মধ্যমণি সেই প্রিয় ভ্রাতা কে না বলেই গান্ধারী চোখ ঢাকলেন। ভীষ্ম ছিলেন অন্ধ সম্রাট ; তিনি চেয়েছিলেন গান্ধারী হবেন সাম্রাজ্ঞী কিন্তু গান্ধারী তা চায় নি। তাই ধৃতরাষ্ট্র  কেবল গান্ধারীকে 
শুধুমাত্র পুত্র উৎপাদক যন্ত্র হিসাবে দেখেছিলেন। 
ব্যথিত শকুনি৷ আর না, ভেবেছিলেন সুখী হবেন গান্ধারী৷ কিন্তু কি পেয়েছেন তিনি ; ভালোবাসাহীন যন্ত্রে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছেন প্রিয় ভগিনী, মানতে পারলেন না শকুনি৷ আজ গান্ধারী কৃশপদেহী। ভূলন্ঠিত ধারণা আজ তাচ্ছিল্যের ভৈরব আঁতাতে যেন প্রকাশ পেলো। অজশিশুর সাথে বিবাহের কারণ জানতে চেয়ে শকুনির কাছে বিলাপ করলে, শকুনি বললেন " ক্ষান্ত হও গান্ধারী, ক্ষান্ত হও!" যদি কেউ প্রিয় ভগিনীর সংসারে  সুখ চায়, তবে কি খুব অপরাধ!  যদি নারী অপমানের প্রেমকে ভ্রাতার বুকে ডুগরে কাঁদে, তবে কি সেই ভ্রাতা প্রতিশোধ প্রেমী হলে খুব অপরাধ!  

যদি সবটুকু যন্ত্রণা রেখে ভাই প্রিয় ভগিনীকে অজশিশুর হাতে ভয়ে তুলে দিতে বাধ্য হয়, তবে কি সেই ভ্রাতার প্রতিবাদ খুবই অপরাধ৷ ক্ষতবিক্ষত গাঙ্গেয় যখন প্রতিশোধের আগুন নিয়ে ধ্বংসের পথে হাঁটতে পারেন, তবে সৌবল শকুনির অনুযোগটা রক্তাক্ত হতে বাধ্য৷ গান্ধারীকে দিয়েও তিন দিবস কাল না রেখেই হস্তিনাপুর গান্ধারকে  আক্রমণ করে। রাজা সুবল কারারুদ্ধ হয় । হস্তিনাপুরে নারীরা সুরক্ষিতা। কিন্তু গান্ধারবাসী নাকি বিবাহের দিন অন্ন স্পর্শ করেন নি,তাই দ্বিপ্রহরে গান্ধারের জন্য এলো এক অন্নের দানা। এ কেমন আত্মীয়ের বন্ধন। হ্যাঁ, অভুক্ত হয়েছিল সকলেই৷ সেদিন শকুনি ঠিক করেছিলেন তিনি প্রতিশোধ নেবেনই৷ আর তার জন্য শকুনিকে জীবিত থাকতে হবে৷ প্রতিশোধ নিতে হবে শকুনিকে৷ গান্ধারী চোখের জল, কান্না, অভিমান,অপমান, তছনছ করা গান্ধারের হয়ে কথা বলবে শকুনি।  এটাই তো স্বাভাবিক৷ নিজের চোখের সামনে পিতার কান্না, অভুক্ত পিতার অসম্মান, ভগিনীর নারীত্বের প্রাপ্তি অস্বীকার,  তাই ধিক্কার। বীজ বপন হলো স্বাভাবতই৷ প্রবঞ্চনার সংসারে তাই শকুনির প্রতিশোধ স্পৃহা দোষের হয় কি! (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours