শাম্মী তুলতুল, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও শিশুসাহিত্যিক, বাংলাদেশ:
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেশীররভাগ নারী বরাবরই অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত, উপেক্ষিত। তারা বাধা পড়ে আছে কঠিন বৈষম্যের শেকলে। আর এই বোধ থেকেই নজরুল নারীর মুক্তির কথা ভাবলেন। তিনি জানতেন, শত আঘাত সহ্য করেও নারী তার স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল। তিনি গান, কবিতা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা এত কিছুতে বিচরণ করার পরেও নারীর অবস্থানটিকে সমাজে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তাইতো তিনি বলেছেন
‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর।’
তিনি তাঁর কবিতায় আরো লিখেছেন-
‘জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী। সুষ্মা লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে সঞ্চারি।’
নজরুল সমাজের রীতিনীতিগুলো পরিবর্তন করে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীকেও বদলানোর কথা ভাবলেন। নজরুল নারীকে তাঁর সকল প্রেরনার উৎস মনে করেছেন। নারী তাঁর কাব্য প্রেরণারও উৎস। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও নারীর প্রভাব ও প্রাধান্য ছিল বেশি। কবি জীবনে যেসব নারীর আগমন ঘটে তাদের মধ্যে প্রথমে আসে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আরা বেগম। এরপর আশালতা সেন গুপ্তা, ফজিলাতুন্নেসা, উমা মৈত্র, রানু সোম, জাহানারা বেগম প্রমুখ বিদুষী মহিলা। কবি নার্গিসের প্রতি এত অনুরক্ত ছিলেন যা তাঁর লেখনিতে বার বার ফুটে উঠেছে। দোলনচাঁপা কাব্যের সমর্পণ কবিতায় কবি প্রিয়তমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন এভাবে :
‘প্রিয়,এবার আমায় সপে দিলাম
তোমার চরণ তলে
তুমি শুধু মুখ তুলে চাও
বলুক যে যা, বলে।’
নজরুল কাব্যের মূলবাদী স্বর-সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের উদ্দিষ্ট শুধু বিদেশি শাসক, তৎকালীন সমাজ কিংবা এদেশের পংকিল রাজনীতিই শুধু নয়, নারীর স্থানও ছিল তাতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর কাব্যে স্থান পায় দেশের অস্থিতিশীলতা, মানব প্রেম, স্বাধীনতা ও নারীদের প্রতি রাগ-অনুরাগ। দেশের তৎকালীন সমাজ-সংসার ও নারী সমাজকে নিয়ে কবি ছিলেন ব্যস্ত। তাই তো কবি লিখেছেন -
‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
তিনি নারীকে দেখেছেন স্বতন্ত্র সত্বারূপে। তিনি নারীর স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির বিষয় ভেবে লিখলেন-
‘মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী,
ভেঙ্গে ফেলও শিকল
যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু
ওড়াও সে আবরণ
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন
যেথা যত আভরণ।’
সব ধরনের অন্যায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ সবসময় সোচ্চার ছিল। অবাক হতে হয় এই ভেবে, আমরা আজ নারীর সমান অধিকার আদায়ে আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ সে যুগেও নজরুল নারীর পক্ষে আন্দোলন করে গেছেন।
তাই তো কবি বলেছেন ‘সে দিন সুদূর নয়/ যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’
নজরুর ভাবনায় নারী øেহময়ী, নারী ভগ্নি, নারী বীর, নারী প্রেমিকা, নারী মাতৃভূমি, নারী কাব্য প্রেরণার উৎস। তার ভাবনায় নারী ছাড়া পৃথিবী অচল। তাই তিনি বলে গেছেন,
‘কোনো কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’
জাতীয জীবনে নারী সমাজকে উপেক্ষা করে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষের সমতা। নজরুলের একদিকে সংগ্রাম ছিল জীবনে, সংগ্রাম ছিল লেখনিতে, সংগ্রাম ছিল দাম্পত্যে। আর অপরদিকে তাঁর সংগ্রাম ছিল কবিতায় নারী জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী কণ্ঠের।
আসলে নজরুল দর্শন অনুযায়ী নারী মুক্তি আন্দোলন তথা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে, নারীর নিজের সত্বা, নিজস্ব অধিকার এসবের ভিত্তি নির্মাণ করে একটি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নজরুলের কাব্য সাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সৃষ্টির পর থেকেই নারী ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি সব ধরনের ভিন্নতা থাকা সত্বেও বিশ্বজুড়ে নারী তাঁর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত অবস্থানের সংগ্রামে যুদ্ধ করে যাচ্ছে অনন্তকাল।
তাইতো নজরুল নারীকে তাঁর জীবনের সমস্ত চিন্তা চেতনা দিয়ে ভেবেছেন। কবির মতে, অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে। অত্যাচারকে অত্যাচার বলতে হবে। মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে হবে। এই আত্মবশ্বিাস অর্জন করতে হবে।আত্মবশ্বিাসী জাতিকে অন্য কোন জাতি শোষণ করতে পারে না। তেমনি, নজরুলের কথায় নারীরাও আত্মবশ্বিাসী। এই আত্মবশ্বিাসরে জোরেই নারী একদিন সফল হবেই হবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours