জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার ও চিত্রশিল্পী, কলকাতা:

প্রান্তদিনের কোটর থেকে ডেকে যায় কোকিল।
মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে অকালবসন্তের মর্মর
কোথা হা! হন্ত চিরবসন্ত।

যেদিকে প্রসারিত হ‌ওয়া যায়, শুধুই হলুদ ফুল। বাসন্তী শিমুল, রক্তিম পলাশ, অবিন্যস্ত জারুলের বল্লরী। ফাল্গুনী হেমলতায় অদৃশ্য হয়েছে চেনা চরাচর।

দ্যুলোকে অমল মেঘের সারি উড়ে চলেছে নিরুদ্দেশ যাত্রায়। যেন এক পরিযায়ী বিহঙ্গের দল। আহা! যদি ওর পিঠে স‌ওয়ার হ‌ওয়া যেতো। যদি সেই নির্জন মেঘের দ্বীপে খুঁজে পাওয়া যেতো পরমাকাঙ্ক্ষিত স্নেহবাস। আহা! যদি সেইখানেই হতো চিরনির্বাসন।

ভাবনায় স্তব্ধতা আসে না। মোর ডানা নাই আছি এক ঠাঁই, সে কথা যাই পাশরি। কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার, সে কথা যে যাই পাশরি।

এই অযাচিত, অপ্রার্থিত নিভৃতবাসে মনের কোরকে কোরকে চলেছে এক নিরবচ্ছিন্ন বিনিময়। খাঁচার পাখি আর বনের পাখির এক নিরন্তর সংলাপ। এক বহতা নদীর স্রোত। নদীর দুই কূলের মতন তারা এপারে ওপারে কথকতা বলে। জীবন বয়ে চলে তার মাঝের নদী হয়ে। কিন্তু কোথায় বয়ে চলে ? বয়ে চলে নাকি শুধুই চলে ? যাকে বয়ে চলে, সে কি নুড়িপাথর নাকি হৃদয়ভেদ্য আঁচড় নাকি অন্তঃসলিলা ফল্গুর ক্ষরণ ? সে কি সঞ্চয় নাকি এক অমোঘ অপরিমেয় ভার ? চলার শেষ কোথায় ? কোন নন্দনের মোহানায় ? সেই কি ঈপ্সিত চিরবসন্তের দেশ ? এ যাত্রা কি সেইই বসন্তের‌ই উৎসটান?
রবিঠাকুরের গান পানসির মতন ঘাটে এসে থামে। এক দুর্লঙ্ঘ নিমন্ত্রণ। সংসারের সহস্র কোলাহল, আদিগন্ত ডোর, ক্ষুদ্র বুদ্ধি মেহের আলীর চিৎকারে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে - তফাৎ যাও - তফাৎ যাও। ভেসে পড়ো ঐ বহমান তরীতে। সকলের ঘাট নেই। সকলের ঘাটে পানসি এসে ঠেকে না। সকলের নিমন্ত্রণ‌ও থাকে না। চলো হে, চলো। নিজেকে নিঃস্ব করে নিয়ে, নৈবেদ্য করে নিয়ে চলো। এ পানসি বড়োই পেলব। মেদটুকু ঝরিয়ে না উঠলেই অনিবার নৌকাডুবি।

'সূর্য পাটে গেছে নেমে
সুবাতাস গেছে থেমে
খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা আঁধারে।'

উঠে পড়ো। উঠে পড়ো।

পায়ের নীচে আসন, আসনের নীচে তরণী, আর তার নীচে অথৈ ডুব। সেখানে এক বাও দুই বাও কেন লক্ষ বাওও মেলে না।

ধীরে ধীরে রাঙা হয়ে ওঠে দিগন্ত। সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যাদীপের শিখায়, অন্ধকারের রাজটিকায় নিবিড় হয়ে বসেন রবিঠাকুর। ধ্বনিত হয় দাঁড় বাওয়ার শব্দ -

'সন্ধ্যা হলো গো, ও মা,
সন্ধ্যা হলো বুকে ধরো
অতল কালো স্নেহের জলে
ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো ...'

আজ এক নিভৃত বৈশাখ।

হাটের কোলাহল নেই, স্তবের বাণী নেই, ফুলের মালা নেই, ধূপের ধোঁয়া নেই। বিগ্রহ, প্রতিকৃতি- কিচ্ছুটি নেই।

আজ রবীন্দ্রনাথ বড়ো একা। বড়ো একক। আজ তিনি বড়ো স্বস্তিতে আছেন। কে কবে দেখেছে এই শান্ত উন্মুক্ত নিরাভরণ পঁচিশে বৈশাখ ? দেড়শ বছর পর একটু প্রার্থিত নিরালা। একটু কাঙ্ক্ষিত নৈঃশব্দ্য। 

লোকালয়ের মানুষ বা একজন প্রতিভাবান স্রষ্টা  বলতে আমরা সাধারণত যা ধারণা করি তেমনটি বোধহয় তিনি নন। তিনি এক নির্জন সাধক। এক নিঃসীম নিঃসঙ্গ নিরালায় আত্মস্থ উপাসক।

কান বন্ধ করে তাঁর গান শুনতে হয়। চোখ বন্ধ করে তাঁকে দেখতে হয়। নিবিষ্ট হয়ে অনুভব করতে কেটে যায় জন্মান্তর।

বর্ষণসিক্ত বৈশাখ আজ সেজে উঠেছে বসন্তের রঙে। কী মধুময় এই উদযাপন। কী অপূর্ব এই পঁচিশে বৈশাখ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours