প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

স্রোতের বিপরীতে চললে পথের সামনে বিদ্রুপ করবে রঞ্চমঞ্চের মানুষ। অবতীর্ণ হবে বিষাক্ত পানপাত্র হাতে, তবু কলম তো পরাজিত সৈনিক হতে পারে না,  তাই সৃষ্টিকার্যের অপরিহার্য অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে আজ শকুনি চরিত্রটি গুণে অগুণে শব্দ বন্ধনী দিয়ে এঁকে দিলাম। একদিন গান্ধারী শকুনিকে প্রশ্ন করেছিলেন, " আমাদের সমাজে পুরুষ ও নারীর মর্যাদা ভিন্ন কেন! " শকুনি উত্তর দিয়েছিলেন, " প্রাকবিবাহ পর্বে গৌরীপূজন কোন কোন দেশে ধুমধামে পালিত হয়! " আসলে নারী যখন গৌরি, তখন সমাজ আগলে নেবে, কিন্তু নারী যখন রুদ্রমূর্তিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, তখন তাকে বাধা দেবে না, এমন মানুষ পাওয়া যায় না। 
স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গেলে সচল স্বতন্ত্র যুক্তিগ্রাহ্যতা একান্ত আবশ্যক৷ একলা পথ হাঁটার দিনে অপেক্ষার চোরা স্রোতে কেউ নিবিড়ে আঁকড়ে নেবে ব্যক্তিসত্ত্বা, কেউ পথ হেঁটে দেবে, এইসব কথা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই না। একলা হাঁটার ক্ষুধার্ত তেজ যখন প্রজ্ঞার পথে শীল হাতে প্রেরণার সুখ হয়, তখন অসুখ কথাটা উদাস রাক্ষস মনে হয়। অতৃপ্তির ভ্রুণ বুকে নিয়ে ঘূর্ণাবর্তের স্পন্দন যদি ইতিবাচক হয় তবে অপেক্ষা নয়, মূর্ত হয় পথ। কিন্তু যেখানে গান্ধারীর মতো স্পর্ধায় জয়ী বিজিতা কেবল উচ্চাকাঙ্খী হয়েছে, সেখানে  শকুনি কিন্তু কংস হতে পারেন নি, কারণ গান্ধারী বাধ্য " কস্য ত্বং " প্রশ্নে। আমিত্বের আধারে তিনি নিজেকে বরাবর সুরক্ষিত রেখেছেন। 

গান্ধার একটি ছোট্ট প্রদেশ। সেখানে শকুনি রাজ্যবিজয়ে বিশ্বাসী। রাজ্য বিস্তারে সিদ্ধহস্ত শকুনি পিতা সুবলকেও হেয় করেন৷ শুধুই স্বার্থের তাগিদ;  পরিখা নির্মাণ, শুভস্তু নদীর জলকে ঢুকিয়ে হিংস্র জলজ জন্তুর আবাসস্থল গড়ে তোলা..  সবটুকুই যেন নখদর্পণে৷ গান্ধারী এই ভ্রাতাকেই অধিক সখ্য ভাবেন। বাসুদেবের স্ত্রী মতো তিনি ভ্রাতার ক্রুরতার শিকার হতে পারবেন না, না তিনি সখ্যতা সারাজীবন বজায় রেখেছেন৷ যুক্তিবাদী বোধ, অতিলৌকিকতায় গান্ধারীর কাছে শিকুনি নায়ক। একাধারে শকুনির শিবভক্তি, অপরদিকে গান্ধারীর নারায়ণে ভক্তি যেন মহাদেবের বুকে গরুড়ধ্বজ বাস, অভিন্নহৃদয় ভাই বোন৷ 
প্রাসাদের উপকন্ঠে প্রজাহিতৈষী বলতে যা বোঝায় তা শকুনি ভোগ করেছেন। স্ত্রী আরুর্শী যখন
সন্তান সম্ভবা তখন শকুনি গান্ধারের সুঘ্রাণ নির্যাসে শশব্যস্ত থেকেছেন। জীবন বড়ো মনোরম হয়েছে শকুনির।  গান্ধারী দিনে দিনে চন্দ্রকলার মতো বেড়ে উঠেছেন। এমন পরিপক্ক মিষ্টতা থাকতেই তো পাণিগ্রহণ করতে হয়, কিন্তু সেই সময় শকুনি গান্ধারী নির্মিত বাগানে রস আঘ্রাণে মজে আছেন। উপহাস করেছেন গান্ধারী। সৌন্দর্য ক্ষুধা কি এমনই যে গান্ধারীর দিকে তাকাবার সময় নেই। একমাত্র প্রিয় ভগিনীর তো রাগ হবারই কথা। 

এখন প্রশ্ন এই গান্ধারে কেমন ছিলেন আদরিণী ভগিনী। কারণ যাকে নিয়ে এতো বড়ো উপাখ্যান তাঁকে একবার পরখ করতে হয় বৈকি। এ যেন আলোচনার প্রাক মুহুর্তে  একটু ভণিতায় আনুষাঙ্গিক  আলাপন৷ ষোড়শ সখী আর দাসীর বুকে কুসুমরাজি সাজিয়ে পদ্মাপলাশাক্ষি গান্ধারী৷ অভিমানী, নারীর বুকে রক্তবর্ণের তেজ, মানায় ভারি। 

গান্ধারী জানেন, শকুনি, গান্ধারীর জন্য আত্মবলিদানে প্রস্তুত চিরকালই। গান্ধারের স্তম্ভ তিনি। তিনি ধনু ও তূণীর পিয়াসী৷ বৈরাগ্য স্পর্শ করলে অনুভূতির লালিত্য ক্রিয়া করে, তাই তো তাঁরা উভয়ই যুগলবন্দী।  তাই বুদ্ধিবত্তা তাঁদের প্রকৃত অস্ত্র। যেদিন সুবল পূর্ণ অবয়বের গাঙ্গেয় - এর পরিচয় জ্ঞাপন করেছিলেন, সেদিন শকুনি বুঝেছিলেন যে ভীষ্ম মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হতে দ্বিধা বোধ করেন নি, যে ভীষ্ম পরশুরামের শিষ্য হয়ে, তাঁর কটুক্তি শুনেও বিচিত্রবীর্য - এর কারণে কাশীরাজের তিন কন্যাকে হরণ করেছিলেন, সে হাতে ধৃতরাষ্ট্রের জন্য গান্ধারীকে তিনি দিতে রাজী। তাছাড়া এই পাণি হাতে যদি সন্তানতুল্য গান্ধার বেঁচে যায়, তবে তাই শ্রেয়। প্রাথমিকে শ্যামলিমা গান্ধারের দিকে চেয়ে গান্ধারী। তাঁর ভূমির সৌন্দর্য তিনি। সন্তানসম প্রজার কাছে তিনি মাতৃ রূপে পূজিতা নারী, তাই স্পর্ধা আর রক্ত নয়,  নারায়ণের ইচ্ছাতেই গান্ধারী রাজী।। " জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী।"

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours