শ্রাবণী সোম যশ, লেখিকা, দুর্গাপুর:

"ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম।

তেমনি তোমার নিবিড় চলা,মরমের মূল পথ ধরে"।

মরমেই গেঁথে থাকে দাম্পত্যের গোধূলিবেলার প্রেম। বাইরে থেকে টেরটি পাবার উপায় নেই। ঠিক যেন খসখসে কালো তালের ভেতর নরম কচি শাঁসটি। আলতো কামড়ে কখন যে মিষ্ট রস গড়িয়ে আসবে তা সে নিজেও জানেনা। সন্ধ্যের পুজোর পাট চুকিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েই গিন্নী হাতেনাতে ধরে ফেললেন কর্তাকে। দেখি ,শিগগির দেখাও হাতে কি নিয়ে লোকাচ্ছো। ওহ মা,এই ভর সন্ধ্যায় ছাতুর শরবত খাচ্ছ কেন। এখুনি রুটি খাবে তো” মনি কর্তার আমতা আমতা উত্তর “আজ আর তোমায় রুটি করতে হবে না। সকাল থেকে অনেক খাটনি গেছে তোমার। গিন্নি ওসবে মোটেই পাত্তা দেন না।উমমমভীমরতি হয়েছে বুড়োর। ভারী তো কটা রুটি ও আমার কিছুই না। এই গৃহবন্দী অবসরে প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠ ছুঁয়ে এতদিনের সম্পর্ক যেন নতুন করে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন দুজনে যেখানে দাম্পত্যের সুর তালে কাক চিল সদর থেকে মুখ দেখিয়েই ইউ টার্ন নিতো ইদানীং সেখানেও অনুরাগের রঙে কার্নিশে পায়রা বকম বকম করছে। শরীরী টান বলতে প্রায়ই গিন্নি ছোট্ট চিমটি টা নিয়ে কর্তার মাথা থেকে বেছে বেছে পাকা চুল কটা তুলে দেন। আবার কর্তা হয়তো গিন্নির ফাটা গোড়ালিতে একটু গরম বোরোলিন লাগিয়ে দেন। সকাল সকাল উঠেই থলে হাতে বাজার ছোটার বালাই নেই। পাট নেই পোস্ট অফিসে গিয়ে M.I.S এ লাইন দেবার। তবে হ্যাঁ বাড়িতে গিন্নির হাতে হাতে এটা সেটা করে বেশ সময় কেটে যাচ্ছে। গিন্নিও খুশি। চিবুকে টোল ফেলে হাসলে এখনও বুকের বাঁ দিকে ইমন  মূর্ছনায় ভরিয়ে দেয়। গিন্নির মুখঝামটায় ঝামা ঘষে জলখাবার খেয়েই রোজ গিয়ে বসতেন মোড়ের মাথার চা দোকানে। গুলতানি সেরে বাড়ি ফিরতে পাক্কা একটা দেড়টা।ততক্ষণে গিন্নির  মুখ আর জ্যৈষ্ঠের সূর্যে তফাৎ বোঝার কোনো উপায় নেই।কতদিন যে মুখপানে ভালো করে চেয়ে দেখাই হয়নি। মুখটায় কি যেন নেই নেই লাগছে ! এই শেষ বিকেলেও রাঙা হয়ে ওঠেন গিন্নি। আড়াল খোঁজার অছিলায় বাসন কটা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ছড়িয়ে যায় মেঝেয়। ছুটে তুলে দিতে আসেন কর্তা। মাথায় মাথায় ঠুকে যায় দুজনের। চপল কিশোর কিশোরীর মতো হেসে ওঠেন দুজনেই। নাকচাবিটি হারিয়ে গেছে,আলো নেইকো মুখে। দু হাতের মাঝে গিন্নির মুখখানি ধরে বলেন,  লকডাউন টা মিটুক একবার। বাগানের পাঁচিল বেয়ে বেড়ে ওঠা মাধবীলতার কচি কিশলয় রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে প্রেমের মিষ্টি সুবাস কুড়িয়ে আনে, আপন খেয়ালে কুসুমিত হয় শাখায় শাখায়। 

 

                গিন্নীই বা কম যান কিসে! চুপি চুপি ছানার জিলিপি বানিয়ে খাবার টেবিলে রেখে দিয়ে ভুলে যাবার ভাণ করেন। কর্তার খাওয়া শেষ হতেই মুখে কপট ভ্রুকুটি সাজিয়ে বলেন যদি কেউ হঠাৎ এসে পড়ে বাড়িতে  , তাই করে রেখেছিলাম। টেরটিও পেতে দেন না যে হাঁটুর ব্যাথা নিয়েও  বুড়োর জন্যে সোহাগ করে বানিয়েছেন। বলি এই লকডাউনে কে আসবে শুনি ওই জিলিপি খেতে ! এই প্রশ্ন কি কর্তার মনে উঁকি দেয় না বিলক্ষণ দেয়। তাইতো গিন্নির হুকুম মেনে ডায়াবেটিক বাবু রোজকার হিসেবের থেকে আরো আধ ঘন্টা বেশী পায়চারী করেন বাগানে গৃহবন্দী দশায় গিন্নির বেশ ভালোমতোই রপ্ত হয়ে যায় কর্তার চা দোকানের আড্ডার মজলিশি ভাষাআর কর্তাও দিব্যি শিখে যান আদা ছেঁচে দুধ চিনি দিয়ে কড়া করে চা বানিয়ে গিন্নির মুখের সামনে ধরতে। দুজনেই যেন দুজনকে নতুনভাবে চেনার অবকাশ খুঁজে পায়। চাকরী হোক বা অবসর জীবন, ব্যস্ত রোজনামচায় অধিকাংশ মানুষই নিজ নিজ বৃত্তযাপন করছিলেন। সুখী গৃহকোণটির  খুঁটিনাটি খবরের থেকে অমুক পাড়ার অমুক বাবুর খবর ছিল অনেক বেশি সুস্বাদু। গৃহবিমুখ মানুষ আজ নিরুপায় হয়ে গৃহবন্দী। এটাও তো সত্যি মরা মরা’ বলতে বলতেই রাম রাম’ হয়ে যায় একসময়। শুরুতে যেটা ছিল নির্ভেজাল বাধ্যতা, আজ যেন সেখানেই একটু একটু করে রঙের প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ছে। ছোট ছোট মূহুর্ত নকশী বুনছে সময়ের হাত ধরে। গেটের পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা নয়নতারার হাসি ছুঁয়ে যাচ্ছে মনধুয়ে দিচ্ছে খুচরোক্লান্তি । রোজই তো বেড়িয়েছেন এই গেট খুলে পথের টানে। কই,  কখনো তো চোখে পড়ে নি ! নাকি চোখটাই এতদিন লুকিয়েছিলো অভিমানে। বাহিরপানে চোখ মেলার আনন্দ একটু একটু করে চুঁইয়ে পড়ছে মনের শার্সি বেয়ে। ঠোঁটের কার্নিশে খেলা করছে আলতো হাসি।

                          বিজ্ঞান- প্রযুক্তি আজ মানুষকে জয়ের শিরোপা পরিয়েছে। তবুও হ্যাঁ তবুও কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানও অসহায়। সাময়িক হলেও। অগত্যা ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ল্যাপটপ থেকে চোখ সরানোর আগেই শুভ্রর  নাকে এসে লাগলো ফিল্টার কফির কড়া গন্ধ। এক চুমুকেই মুখ থেকে মন ছুঁয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল সেই আমেজ। একটা হাত মাউসে রেখেই অন্য হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল মিমির আঁচল( পড়ুন ওড়না)। শুভ্রর হ্যাঁচকা টানে এক্কেবারে ওর কোলের ওপর। ইশ! কি যে করো। এক্ষুনি কফিটা উল্টে যেতছদ্ম রোষ মিমির আদুরে গলায়। “ অনেক কাজ বেড়ে যেতো,  তখন! হাবি ঘরে থাকলেও আদর আবদারের সময় কোথায় এখন! কাজের দিদি যে গৃহবন্দী। দরজায় দাঁড়িয়ে  একমুঠো চুমু ছুঁড়ে দিয়েই শুভ্রর নাগালের বাইরে মিমি। হাজার হাজার শুভ্র মিমির এখন একই গল্প। কপোত-কপোতীর এই খুনসুটি অনেকটাই হলদেটে হয়ে গেছিল কর্পোরেট সেক্টরের অত্যধিক কাজের চাপে। শুধুই কি তাই ! অপরকে টপকে এগিয়ে যাবারবছরে চার ছয় বার বিদেশ পাড়ি দেবার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কতকটা দায়ী বৈকি। হাজার কাজের ঝামেলাতেও আজ অবকাশ হয় ফ্ল্যাটের ঘুলঘুলিতে ঠোঁটের মাঝে কুটো বয়ে আনা শালিখের বাসা বোনা দেখার। ওরা তো স্বাধীন। ওদের রাজ্যে নেই লকডাউনের করা নজরদারি। তাও একটা দুটো শুকনো পাতা, কুটো দিয়ে কি পরম মমতায় ঘর বাঁধছে দুটিতে।

 

                      সমীক্ষা বলছে গৃহবন্দী অবস্থায় পরিবারে ভায়োলেন্স বেড়ে যাচ্ছে। এতদিনের চেনা যাপন ভেঙে মানুষকে নতুন করে শিখতে হচ্ছে বহুকিছু। কেবলমাত্র সুস্থভাবে বাঁচার তাগিদে। কিছু পেতে গেলে কিছু তো দিতেই হয় ! তবে কি আমরা বুঝবো লকডাউনের আগে প্রতিটি গৃহে শান্তির সুললিত বাণীর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ক্রোধ উষ্মা প্রকাশকারী ব্যক্তিটি হয়তো আগে গৃহের বাইরেই পর্যাপ্ত সময় কাটাতেন। তাই তার উষ্মা প্রকাশের সময়ও ছিল সীমিত। আজ সেই অধৈর্য্য মানুষটিকে গৃহের অবসরে মেনে নিতে হচ্ছে পরিবারের বাকি সদস্যদের। ক্ষোভ বিরক্তি কুন্ডলী পাকাচ্ছে উভয় তরফেই। আগ্নেয়গিরিও তো প্রশমিত হয় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর। সেই মানুষটি তার উষ্মা প্রকাশের পর এখন পথে না বেরিয়ে গৃহকোণেই খুঁজে নিচ্ছেন ভালো থাকার উপচার সাথে হয়তো ভালো রাখারও। নিজের উগ্র আচরণের যথাযথ উত্তর মিলছে না কার্য-কারণের ঝুলি হাতড়ে।প্রিয়জনদের প্রয়োজন আর সুখ শান্তি নিয়ে ভাবনা চিন্তার অবকাশ মিলছে এই সময়। একান্তে ধোঁয়াযাপন করতে করতে খুলে যাচ্ছে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত। মানুষটি বুঝছেন সবসময় প্রভুত্ব না খাটিয়েও শুধুমাত্র ভালোবেসেই দিব্যি ভালো থাকা যায়। আবার বিপরীত সমীক্ষা বলছে দেশে হঠাৎ করে জনসংখ্যার হার বেড়ে যাবার সম্ভাবনাকেও একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এটাই তো মানুষের চরিত্র। বহুক্ষেত্রেই মানুষটির রাগ উষ্মা প্রশমিত হলে তার ভালোবাসার প্রকাশ বেড়ে যায় চতুর্গুন। উগরে দেওয়া অসংলগ্ন কথার বোঝা ভাসিয়ে দিতে চান ভালোবাসার চিরন্তন স্রোতে। তাইতো এখনও পাঁচ বাই সাতের নিরাপদ আশ্রয়ে যাবতীয় কলহ বিবাদের সুমধুর সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। 

 

"কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি।

আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে"।

দুজন দুই শহরে বন্দী। সপ্তাহান্তে যেটুকু একাত্মতা, সেটাই পাথেয় হতো আগামী সপ্তাহের। কর্মসূত্রে বহু দম্পতি আজ দুই শহরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। জীবিকার প্রয়োজনে যে যার নিজের মতো করে   কাজে মন বসিয়ে নিয়েছে। যারা স্বাস্থ্যকর্মী,  এই সময়ে তাদের পরস্পরের সুস্থতার জন্যে দুশ্চিন্তা বিরহ কে অনেকটাই গ্রাস করে নিয়েছে। অগণিত রুগী ,যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি,  সতর্কতা সামলে বিরহের অবকাশ থাকে কতটুকু! " ভালোবাসার সময় তো নেই ব্যস্ত ভীষণ কাজেহাত রেখোনা বুকের গাঢ় ভাঁজে।"  তবুও এই নিদাঘ দুপুর পার করে যখন কালবৈশাখী ওঠে তখন কি বিচ্ছিন্ন দুই দম্পতির বুকেও ঝড় ওঠে না! মধ্যরাতের তারাকে সাক্ষী রেখে একা শয্যায় মন কি একটা চেনা স্পর্শের খোঁজে দিশেহারা হয় না! সন্ধ্যেবেলায় দূর থেকে ভেসে আসা চাঁপা ফুলের গন্ধে  প্রিয়জনকে কাছে পাবার আকাঙ্খায় উদ্বেল হয় অনুভূতি। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসের পর মাস এই দূরত্ব,  আজ কি ভীষণ ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে একজনের জীবনে আরেকজন ঠিক কতখানি জুড়ে আছে। পিছনে ফেলে আসা পরস্পরকে জড়িয়ে বাঁচার প্রতিটি মুহূর্ত আজও গভীরে কোমল ধৈবত জাগায়। অপেক্ষা শুধু এই দুর্যোগের কাটাকুটি খেলা শেষ হলে, হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলার। এই বিপর্যয় কেড়ে নিচ্ছে শান্তি, ভুলিয়ে দিচ্ছে স্বস্তি, অকালে চলে যাচ্ছে অগুন্তি প্রাণ। বিশ্বজুড়ে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সার্বিক ক্ষতির মাঝে চুপিসাড়ে বেড়ে ওঠা ভালোবাসাটুকুই তো উপরি পাওনা আমাদের। এই ভালোবাসাটুকুই এনে দেবে ধৈর্য, মানিয়ে নেবার সহ্যশক্তি। এই ভালোবাসাই হয়ত  শেষ অবধি জিতিয়ে দেবে আমাদের।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours