সাগরিকা মুখোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা:

কাল গেছে মহান মে দিবস। বহু মিমস নেট এলাকার বারোয়ারি অঙ্গনে ঘুরছে। অতিমারীর প্রেক্ষিতে যা অশ্লীল শুধু নয়,নির্মমও বটে।

নাঃ! ১৮৮৬ তে শিকাগোর হে মার্কেটে ৮ঘন্টা কাজের দাবিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কথা বলতে বসিনি।
অথবা বলতে বসিনি  যাদের দাবিতে, যাদের জন্য এই ঘটা করা মে দিবস তাদের বেশির ভাগ মানুষ আদতে  জানেইনা 'মে ডে' খায় না মাথায় দেয়।
যাবনা কেন কারখানার শ্রমিক টু টেকনো শ্রমিক কাজ করে চলেছে আট ঘন্টার অনেক বেশি সময় ধরে, সেই বিতর্কেও।

কারণ বর্তমানের ভয়ানক পরিস্থিতি তর্ক-বিতর্কের অনেক ঊর্ধে। সাধারণ শ্রমিক ও পরিযায়ী শ্রমিক....বিরাট সংখ্যা। শুধু পরিযায়ী শ্রমিকই ১৪ কোটি, ১৪র পিঠে সাতটা শূন্য! তার সাথে তাদের পরিবার মানে প্রায় ৫০ কোটি। থাক আর শূন্যর হিসেব কষে লাভ নেই। সত্যিই নেই কারণ শূন্যগর্ভ রাজনীতি, শূন্যগর্ভ শাসননীতি, শূন্যগর্ভ অর্থনীতিতে আশা, বিশ্বাস সবই শূন্য।

 কোভিডের আবহে চিনলাম পরিযায়ী শ্রমিক। জানলাম এদের নাম অভিবাসী শ্রমিক আবার অতিথি শ্রমিকও। কত গালভরা নাম। অথচ অতিমারী দেখালো এরা আসলে কিছু অ-নাগরিক সর্বপরি কিছু অ-ভোটার। এদের নিজের জায়গায় কাজ নেই, কর্মস্থলে নিজের জায়গা নেই ! এরা নিরন্ন, নির্বান্ধব, নিরাপত্তাহীন। বিপদে দলে দলে ঘরে ফিরতে গিয়ে ঘরে ফিরতে গিয়ে পোকা মাকড়ের মতো মরে যায়। just মরে যায়।
এর আগেও অভুক্ত বিপন্ন মানুষের ঢল দেখেছে আমার দেশ।বোঁচকা বেঁধে, কোলে কাঁখে সন্তান নিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে  মাইলের পর মাইল মানুষ হেঁটে চলেছিল গ্রাম থেকে শহরে। ভিত থেকে ভবিষ্যতে। অদ্ভুত ভাবে এবারের মিছিল কিন্তু সম্পূর্ন উল্টো দিকে -- ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে প্রাক-ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে।

 বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে সেই প্রশ্ন : আমরা এগোচ্ছি না পিছচ্ছি?

শুধু পরিযায়ী তো নয়। দেশের ৮৫% শ্রমিক কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। সেই কর্মে নিরাপত্তাহীন 'দিন আনি, দিন খাই' বিপন্ন মানুষগুলির ঘাম রক্ত মিশে আছে আমাদের সাধের ঘরের ইঁট-কাঠে, শ্বেত শুভ্র মর্মর মেঝেতে, শাড়ির নকশায়, গলার নেকলেসে, শার্টের বোতামে, সন্তানের খেলনায়, গাড়ির আরামে, ধানের বস্তায়, ভাতের হাঁড়িতে,শপিং মলের আয়েসে, কমোডের ফ্ল্যাশে...শেষ নেই। কিন্তু এরাই আজ মারা যাচ্ছেন অনাহারে, অনিশ্চয়তার প্রহরে দুশ্চিন্তায়,মারণরোগে।

এটাই কি তাহলে লেনিনের ভাষায় "ধনতন্ত্রের অন্তহীন ভয়াবহতা?" " Horror without end?

এ বছর জানুযারি মাসের অক্সফামের গবেষণা-লব্ধ তথ্য বলছে ভারতের মোট সম্পদের ৭৩% শতাংশ রয়েছে মাত্র ১% মানুষের হাতে। এই ১% ধনকুবেরের  (সংখ্যায় যারা ১০১ জন মাত্র)আয় বেড়েছে গত ১বছরে ২৬%। উল্টো দিকে প্রদীপের নিচে অন্ধকারে সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক স্তরের ৬৭ কোটি ভারতবাসীর গত ১বছর আয় বেড়েছে মাত্র১% -- চূড়ান্ত অসাম্যের এক ভয়াবহ ছবি।

 এই  অসাম্য চূড়ান্ত অন্যায়ও -- যার প্রমান আমরা হাতে নাতে পাচ্ছি এই কোভিড আবহে।  জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের দেশের অনুন্নয়ন মূল কারণ নয়। মূল কারণ হলো কোটি কোটি মানুষের পরিশ্রমের ফসল মুষ্টিমেয় মানুষের পকেটে ঢোকা।
যার মোকাবিলা করার জন্য 'নোট ছাপাবার' দাওয়াই দিতে হচ্ছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে।

এগুলো নিয়ে আমরা কোনো দিন ভাবিনি। রাজনীতি আমাদের এভাবে ভাবতে শেখায় নি। সম্পদের অশালীন অসাম্যে আমরা 'পুঁজিবাদের অন্তহীন ভয়াবহতা' দেখতে পাইনি।চরম বিপদে সমাধান হাতড়াতে তথ্যের অঙ্ক দেখে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হচ্ছে।

প্রশাসনের নীতি দাঁড়িয়ে থাকে পরিসংখ্যানের ওপর। অর্থনীতিকে কোন মাপকাঠিতে মাপ হবে তা নির্ধারণ করে দেয় রাজনীতি। বিগত বছরগুলিতে যখন দেশের আর্থিক অসাম্য বেড়ে চলেছিল তখন আমাদের সামনে 'জিডিপি'র 'খুড়োর কল' ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ মোট সম্পদের বৃদ্ধি। অথচ সুচারু ভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে মোট সম্পদ বৃদ্ধির বন্টনের হিসাবটা। সম্পদের পুঞ্জিভবনের অন্যায়-ভার হারিয়ে দিয়েছিল 'মোট সমৃদ্ধিতে সবার অধিকার' এর ন্যায়কে।

যে বিষবৃক্ষ রচিত হয়েছে স্বার্থসিদ্ধির বদান্যতায়, তার ফল সুদূর প্রসারী।অর্থনীতির পরিকাঠামো না বদলালে ভবিষ্যতের অধিক বিষময় দুর্দিন বদলানো যাবে না।

ভাবতে হবে, ভাবাতে হবে সবাইকে। প্রয়োজনে লড়তে হবে।
 সম্মিলিত হয়ে সুরক্ষিত করতে হবে তাদের ভবিষ্যৎ  বাস্তবিক যারা 'কাজ করে শহরে নগরে', যারা সমাজ-জীবন বয়ে নিয়ে চলার 'দাঁড় টানে, ধরে থাকে হাল'।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours