মুনিয়া মনি, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, বাংলাদেশ:

আমি আগাগোড়া গ্রামের মেয়ে...
এই সহজ সত্যটা স্বীকার করার মধ্যে একটা নির্মলতা আছে,কোনো গ্রাম্যতা নেই...
শৈশব কৈশোর এর দুরন্তপনার সময়গুলো আমার গ্রামেই কেটেছে...
গ্রামের মানুষের আনন্দ -দুঃখ জীবনাচরণ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে...নিজের শেকড়কে  দামাচাপা দিয়ে মস্ত মানুষরূপী অমানুষ হবার প্রতি আমার প্রচণ্ড অনীহা....

এই যে লকডাউন,এই যে গৃহবন্দি জীবন... ধনবান ব্যক্তিরা সাত তলার উপরে বসে বড় বড় বুলি খুব সহজেই আওড়াতে পারেন "Stay home "

কিন্তু যে মুটে-মজুর, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষটি,কিংবা জীর্ণ কৃষক, ঘরের বাইরেই যাদের বেঁচে থাকবার সমস্ত আয়োজন,তাকে কতক্ষণ -কতদিন আপনি ঘরে বন্দি রেখে বাঁচাতে পারবেন;যদি  রাষ্ট্র তাদের উদরপূর্তির যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারে...!

ঘর ছেড়ে যেহেতু বের হওয়া যাবে না বুঝলাম,মাছওয়ালা সবজিওয়ালা তারা যে আপনার আমার কোয়ারেন্টাইন জীবনকে সুন্দর করতে দেদারসে বের হচ্ছে....ওর জীবনের কোনো মূল্য নেই???
সব মূল্য শুধু বড় বড় মাথার নীতিনির্ধারকদের!

রাষ্ট্র কবেই বা ভাবলো এদের কথা...
যেন সভ্যতা বিনির্মাণে এদের কোনো অবদানই নেই....

গ্রামের ৯০% মানুষের কাছে পেটনীতি সবার আগে,এদের ঘুম থেকে ওঠেই গরুর খাবার যোগানোর তাড়া,একটা গরুই হয়তো তার জীবিকার একমাত্র নিয়ামক....
আমার গ্রামের বাস্তবতায় যা দেখছি,করোনা নামক একটা নতুন শব্দের সাথে তারা জাস্ট পরিচিত হয়েছে,এর বেশি কিচ্ছু না.....
জীবন যেভাবে চলতো সেভাবেই চলছে....সকালের কর্মব্যস্ততা, দুপুরের আড্ডা, বিকেলের জনসমাগম, মসজিদে মোয়াজ্জিনের আহবানে সাড়া দেয়া কিছুতেই কোনো কমতি নেই....অহরহ মানুষ ঢাকা থেকে আসছে,হয়তো খুব চাপে পড়ে কেউ কেউ দু-চারদিন ঘর থেকে বেরোচ্ছে না,তারপর যেই সেই....

এর বেশি কি-ই-বা করতে পারে তারা???

লকডাউন ভেঙে একদল মানুষ একবার ঢাকা থেকে গ্রামে এলো,আবার ঢাকায় গেলো এবং আবার ফিরে এলো...

খুব সমালোচনা -আলোচনার ঝড় বয়ে গেলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে....

নিদারুণ সত্য হলো,এমন সংকটে আপনিও প্রিয়জনের কাছেই যেতে চাইতেন...
যে ছেলে বা মেয়েটা শহরে হোস্টেল-মেসে থেকে পড়ালেখা করে,অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে একা সে বাঁচতো কেমন করে!!
মৃত্যুপুরীর মতো স্বজনহীন ঢাকায় তাদের ফেলে রাখতে বাবা মায়ের প্রাণে কেমন করে ধরবে....

এসব না ভেবেই কসাইয়ের মতো সমালোচনা করতে বসে গেলেন!!!
এবং আপনাদের আর বিশেষ কোনো কাজ নেই বলেই এই কাজটা সুচারুভাবে করতে পারছেন....

একবার তাদের জায়গায় এসে দাঁড়ান, জীবন কত নির্মম হয়তো বুঝবেন...

এবং তারা গ্রামে এসেও যে খুব শান্তিতে আছে এমন নয়,মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো মাথায় বাসা ভাড়া দেয়ার তাড়া.....এই বিত্তবান বাড়িওয়ালা তারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে রাখে সচেতনতার বুলিতে....

কয়টা কাজের মহিলাকে নিজে যেচে খোঁজ নিয়েছেন,কয়জন ভাড়াটিয়ার খবর নিয়েছেন?
আপনারা এত উদার বলেই হয়তো টেবিলে সেহেরির খাবার রেখেই আমার ভাইকে খুন হতে হয়....
নির্মভাবে...

মরার আগেও মানুষ প্রিয়জনের সান্নিধ্য চায়,মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের কারণে আপনি - আমি আক্রান্ত হতে পারি এই ভয়ে আমরা তটস্থ....আমরা কিন্তু শ্রমিকদের জীবন নিয়ে তটস্থ না....

রুবানা হকের মতো করে ক্যাপিটালিজম এর চর্চা করতে না পারলে তো আবার আমরা র‍্যাংকিং এ এগিয়ে থাকতে পারবো না....
আমাদের তো ইউরোপ-আমেরিকার সাথে পাল্লা দিতে হবে....

খেয়ে না খেয়ে মুটে মজুর চুলায় যাক, শুধু সাততলার উপরকার মানুষগুলো প্রাণরক্ষা হলেই তো দেশরক্ষা হবে...
ভাবনা কি!

আমি সবসময়  সবকিছু উলটো করে ভাবি....
এই যে পথহাঁটার উদ্দামতা, নিরন্তর ক্লান্তি মেনে নিয়ে জীবনকে টিকিয়ে রাখার অপরিসীম আগ্রহ,এসব দেখে আপনারা খুব মর্মাহত,
আমিতো দেখি এই জরাজীর্ণ, ক্ষয়ে যাওয়া জীবনটাকে বয়ে বেড়ানোর কত পিপাসা মানুষের....

দীর্ঘ ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে হাজার বছর ধরে পথচলায় মানুষের ইতিহাস আজকের যে বাস্তবতায় এসে উপনীত হয়েছে,তার মধ্যে আমি আশাবাদের ইঙ্গিত পাই....চলমানতার ইঙ্গিত পাই...
জীবনানন্দের মতো জীবনবাদিতার ইঙ্গিত পাই....

জীবনমুখী মানবতার জয় হোক,
গ্রামমুখী জনস্রোতের মধ্যে করোনার বীজ আছে সত্যি,কিন্তু তাদের প্রাণে বেঁচে থাকার তীব্র সাহসিকতাও আছে....
ওইটুকুতেও আমি অনেক ভরসা পাই...

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours