মৌমিতা তারণ, লেখিকা, কলকাতা:

কথায় বলে বয়স হলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমন কথা খাটে না। ছোট থেকেই নানাধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি৷ আজ শোনাব তেমনই এক অভিজ্ঞতা।

ক্লাস থ্রি তখন আমার। একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে আমি। ভরপুর সংসারে অনেক মানুষ, অনেক কথা, অনেক নতুন শব্দ। রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে খেলাধুলা, রান্নাবান্না সবরকমের আলোচনায় বাড়ি গমগম করত৷ অনেক পরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি"-র সঙ্গে আমি আমাদের বাড়ির খুব মিল খুঁজে পেতাম। তা ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় নতুন একটা শব্দ শুনলাম -- "গৃহযুদ্ধ"। পাশের দেশে মানে পূর্ব পাকিস্তানে না কি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাড়ির লোকদের খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত তখন৷ ১৯৭০ সাল তখন৷ মাত্র কুড়ি বছর আগে আমার বাবা মা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই বঙ্গে চলে এসেছে। দাঙ্গার ক্ষত তখনও মনকে কুরে কুরে খায়। শুনতাম আমাদের আদি নিবাস নাকি পূর্ব বঙ্গের ঢাকা জেলাতে। ঢাকা ছেড়ে চলে এলেও বাড়ির খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তা, আদবকায়দা সর্বত্র ঢাকা জেলা বিদ্যমান৷ ১৯৭০ এ সে পূর্ব বঙ্গে আত্মীয় বলতে ছিল সেজপিসি আর মায়ের একমাত্র বোন, মানে আমাদের মাসীমা। আমরা কোনও দিনও এই মাসী, পিসিকে দেখি নি।

শুনতাম মেসোমণি নাকি রাজশাহীতে থানার দারোগা ছিলেন৷ পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ লাগার আগেই মেসোমণি মারা গেছিলেন। মাসীমা তার এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকত। বড় ছেলে অনেক আগেই চলে এসেছিল এদেশে। আমাদের বাড়ি আর মামাবাড়ি মিলিয়ে থাকত। ইতিমধ্যে সেজ পিসি তার বড় মেয়েকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে৷ কিশোরী, যুবতীদের জন্য সে দেশ তখন আর নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে কাকুর কাছে আমি গৃহযুদ্ধ বলতে কী বোঝায় জেনে নিয়েছি। অসাধারণ হাতের লেখার অধিকারী কাকু আমাকে অনেককিছুর মানে শিখিয়ে দিত।

তা এমন পরিস্থিতিতে একদিন ভরদুপুরে মাসীমা তার ছেলে, মেয়ে আর ভাসুরের ছেলেকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমাদের বাড়ি চলে এল। পাড়াতে অনেক বাড়িতেই তখন পাশের দেশ থেকে আত্মীয়রা এসে থাকতে শুরু করেছে। একবছর মাসীমারা আমাদের বাড়িতে ছিল৷ মাসতুতো দাদা ও দিদিকে স্কুলে ভর্তি করা হল। এবার আমাদের পাড়াতেই আমার বাবা, মা মাসীদের থাকার জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করে দেয়। মামারাও এগিয়ে আসে ওদের পাশে। ততদিনে "বাংলাদেশ" রাস্ট্রে জন্ম নিয়েছে। মাসীমার ছেলেরাও রোজগার করা শুরু করেছে। ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছে ওরা এই বঙ্গে।
তবে বেশিদিন এই স্থিতাবস্থা ভোগ করতে পারল না মাসীমা। ১৯৭৭ তখন। ক্লাস টেন তখন আমার। একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম মাসীমার স্ট্রোক হয়েছে। ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খুব মন খারাপ হয়ে গেলে। মা খুব কাঁদছে। মাসতুতো দাদা, দিদিরাও। পনেরো দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ১৯ ফেব্রুয়ারী, শনিবার মাসীমা মারা গেল৷ মাঝে তিনদিন আমি হাসপাতালে গেছিলাম দেখতে। ১৯ ফেব্রুয়ারীও গেছিলাম৷ একজন অল্পবয়সী ডাক্তারের আণ্ডারে মাসীমা সেখানে ছিল। নিজের মায়ের মতো করে সেই ডাক্তার মাসীমার চিকিৎসা করেছিলেন৷ মৃত্যুর ঘন্টাখানেক আগে আমি দেখতে গেছিলাম। অনেক যন্ত্রপাতি লাগানো ছিল নাকে মুখে। মাথাটা অসম্ভবভাবে নাড়ছিল ডাইনে বাঁয়ে। বুকের কাছে সেই ডাক্তার বসেছিলেন। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে জানালেন আর কিছু করার নেই। সত্যিই আর কিছু করা গেল না। ঘন্টাখানেক পর সব যন্ত্রপাতি খুলে দেওয়া হল। আবার উপরে গেলাম আমরা। দেখলাম কী অপার শান্তিতে মাসীমা আমার ঘুমোচ্ছে। মাথাটা স্থির। আর ডাইনে বাঁয়ে নড়ছে না।

গতকাল আমার পাড়ার এক পুরনো বাসিন্দা মারা গেলেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন৷ তিনি যে মারা গেলেন গতকাল আমরা সেটা জানলাম শববাহী গাড়ি পাড়ায় ঢোকার পরে। লোকজনও বিশেষ কাউকে দেখলাম না। কেউ কাঁদলও না। এখন মৃত্যু এরকম নিঃশব্দ। কিন্তু ১৯৭৭ এ এমন ছিল না। যে কোনও মৃত্যু কাছের লোক বা দূরের লোক প্রত্যেককে নাড়া দিত। বুক মুচড়ে উঠত। মাসীমার ক্ষেত্রেও তেমন হল। নিকট, দূর প্রত্যেকের মন খারাপ। আমাদের গমগম করা বাড়ি স্তব্ধ।

১৯ ফেব্রুয়ারী শনিবার দুপুর সাড়ে তিনটের সময় মাসীমা মারা গেল। ২৬ ফেব্রুয়ারী, মানে পরের শনিবার দুপুরবেলা আমরা অনেকে বসে মায়ের ঘরে গল্প করছিলাম। আমাদের এই বাড়িটা খুব বড়। সাতটা ঘর। সবচেয়ে বড় ঘরটা বাবা, মায়ের। পাশাপাশি দুটো খাট পাতা। ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলে লম্বা বারান্দা। দু'দিকে অন্যান্য ঘর। মায়ের ঘরে ভেতরের বারান্দার দিকে একটা জানলা আর সেই জানলার উল্টোদিকে ঘর পেরিয়ে গিয়ে আরও দুটো জানলা। ওপারে কলতলা। বাথরুম, টয়লেট ইত্যাদি। ভেতরের বারান্দার দিকে যে জানলা তার উল্টো দিকে বারান্দা পেরিয়ে দরজা। দরজা পেরিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। আর সোজাসুজি কোলাপসিবল গেট। সেই গেট পেরিয়ে বাইরের মেইন গেট খুলেই রাস্তা। মাসীমা বেঁচে থাকতে প্রতিদিনই বিকেলবেলা আমাদের বাড়ি আসত। মায়ের সঙ্গে গল্প করত। আমাদের সঙ্গে মজা করত। সাড়ে সাতটা নাগাদ নিজের বাড়ি চলে যেত। প্রতিদিনই যাওয়ার সময় ঐ সিঁড়ির ঘরের দরজার দুই পাল্লা দু'হাতে ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে বলত, "আসি লো দিদি"। আজও কানে বাজে সেকথা। মাসীমা চলে যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা দুপুরবেলা মায়ের ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। মাসীমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। সিঁড়ির ঘরের দরজা আবজামো ছিল। আচমকা দমকা হাওয়ার মতো একটা হাওয়া সেই দরজা খুলে দিয়ে বারান্দার জানলা ভেদ করে মায়ের ঘরের দুটো খাট পেরিয়ে সোজাসুজি উল্টোদিকের জানলা দিয়ে কলতলার দিকে চলে গেল। ঘরের ভেতর যারা ছিলাম সবাই সেটা উপলব্ধি করলাম। ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে তিনটে। আগের শনিবার ঠিক এই সময়ে মাসীমা আমাদের ছেড়ে চলে গেছিল। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজও মনে পড়ে সেই দুপুর সাড়ে তিনটে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours