শ্রীতন্বী চক্রবর্তী, অধ্যাপিকা ও ফিচার রাইটার, কলকাতা:

গত মার্চ মাসে মুম্বইয়ের দ্য ইনস্টিটিউট অফ হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ক্যাটারিং টেকনোলজি এন্ড অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশনের এক অধিকর্তার সাথে প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী নিয়ে কথা হচ্ছিলো। বলাই বাহুল্য, এই প্রতিষ্ঠানটির গড়ে ওঠার পেছনে স্বর্গীয় শ্রীমতি লীলাবতী মুন্সীর অবদান অনস্বীর্কায্য।১৯৫৪ সালে ‘অল ইন্ডিয়া উওমেন্স সেন্ট্রাল ফুড কাউন্সিল’ যখন তৈরী হয়, তখন সেটির প্রাথমিক যাগযজ্ঞ, এবং সেই প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে চলার পেছনে মূল কান্ডারি ছিলেন লীলাবতী দেবী। এরপর কলকাতা ফিরে এসে বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় খুঁজতে থাকি গুজরাটি মহিলা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিকদের নিয়ে কিছু সারগর্ভপূর্ণ আলোচনা যার মধ্যে ভীষণভাবে উঠে আসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে লীলাবতী মুন্সীর নাম এবং অবদান। ২১ শে মে, ১৮৯৯ সালে, এক গোঁড়া গুজরাটি-জৈন পরিবারে লীলাবতী জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বেশ কিছুটা দেখা, স্বদেশী আন্দোলনের নিত্যনতুন রূপকের সাথে লেখার মাধ্যমে পরিচিত হওয়া এবং তারপর, ১৯২০ সাল থেকে ওতপ্রোতভাবে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে নিযুক্ত করা-১৯২০ তে লবণ-সত্যাগ্রহ, ডান্ডি অভিযান, ১৯৩০ এ আইন অমান্য আন্দোলন এবং মহাত্মা গান্ধীর সাথে থেকে ভারতীয় স্বাধীনতার যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, এক দুর্বার গতিতে চালনা করা সেই আন্দোলনকে সেই সবই এখন ইতিহাসের গর্ভে। বম্বে লেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য ছিলেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত, যা প্রাক-স্বাধীনতা যুগে একজন মহিলার পক্ষে অবশ্যই বেশ কঠিন ছিল। বম্বে রাজ্যসভায় পরে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ সাল থেকে একজন দক্ষ জনপ্রতিনিধি, জনসংযোগকারী এবং সবথেকে বড় ব্যাপার, একজন অবিসংবাদিত মহিলা সহকর্মী হিসেবে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বেশ কিছু দায়দায়িত্ব পালন করে এসেছেন অবলীলায়। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকবার স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার জন্যে। মহাত্মা গান্ধীর একজন একনিষ্ঠ অনুরাগিণী হওয়া সত্ত্বেও, লীলাবতী নিজের স্ত্রী-সত্তা কে কোনোদিন বিসর্জন দেননি, বরং বলা ভালো, প্রাক-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে নিরন্তর লড়াই করে গেছেন ভারতে এক শক্তিশালী নারী-বাহিনীর জন্ম দেওয়ার।
লীলাবতী তাঁর স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী; বিখ্যাত গুজরাটি লেখক কানহাইয়ালাল মুন্সী প্রথম স্ত্রী অতিলক্ষ্মীর মৃত্যুর পর লীলাবতীর সাথে দ্বিতীয়বার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। কানহাইয়ালালের গুজরাটি লেখালিখির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিসরে লীলাবতী কোনোদিনই হস্তক্ষেপ করেননি। বরং, ধীরে ধীরে, যত সময় গেছে, আমরা লীলাবতীর লেখনীশক্তির পরিস্ফুটন দেখেছি বিভিন্ন গুজরাটি প্রবন্ধ, নাটক এবং সামাজিক গল্পে। গুজরাটি লেখকদের জীবনী সজীব হয়ে উঠতো তাঁর কলম-প্রতিকৃতিতে।তাঁর লেখা 'বধূ-রেখাচিত্র' প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে, জন-আন্দোলনের জোয়ারের মধ্যেই। নাটকের জগতেও তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। 'কুমারদেবী' লীলাবতীর লেখা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাটক যা গুজরাটি সাহিত্যপ্রেমীদের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে অনায়াসে|ভারতীয় নারীর শিক্ষার প্রসার এবং তার জীবন যে শুধুমাত্র সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধর নয়, তা লীলাবতীর ইউরোপ যাত্রার ডায়েরি এবং চিঠি পড়লেই জানা যায়| তিনি বেছে নিয়েছিলেন একটি কঠিন সময়কে যখন 'প্রো-ফেমিনিজম' বা 'ফেমিনিস্ট' এসব কোনোরকম বন্ধনীর মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে না রেখে সাধারণের মাপকাঠিতে বুঝতে চেয়েছিলেন  জীবনটা। আধুনিক নারীর কাব্যভাষা নয়, আত্মপ্রতিকৃতির জটিলতা ও পরনির্ভরতা কাটিয়ে একটি সুসংবদ্ধ আত্মিক বিকাশের চিন্তাধারা- এইটুকুই তাঁর  ন্যায্য দাবি ছিল।

সিনেমা বা চলচ্চিত্র জগতেও লীলাবতীর নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। সেন্সরশিপ এ তাঁর নেওয়া পদক্ষেপগুলির এখনো পর্যন্ত যদি অবলুপ্তি না ঘটতো তাহলে হয়তো পর্দা-কাঁপানো বেশ কিছু বলিউড হিরোর রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে যেত পর্দায় চুম্বন-দৃশ্যে সাড়াজাগানো অভিনয় না করতে পেরে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বহুবার চলচ্চিত্রে চুম্বন বা শরীরী ভাষার প্রদর্শ হয়েছে- কখনো বা সিনেমার আভ্যন্তরীন প্রয়োজনে, আবার কখনো বা নির্দেশকের অঙ্গুলিহেলনে। লীলাবতী পর্দায় অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বহু আগেই, ১৯৫০ সালে তৈরী করেন 'সোসাইটি ফর দা প্রিভেনশন অফ আনহেলদি ট্রেন্ডস ইন মোশন পিকচার্স', যার অফিস ছিল বোম্বেতে। এরপর ১৯৫৪ সালে রাজ্যসভায় একটি বিল এ তিনি আবেদন জানান সিনেমার পর্দায় কিছই অকাম্য, অশ্লীল এবং অস্বাস্থকর দৃশ্যের ওপর যাতে আইনি নিষেধাজ্ঞা রোপন করা হয়। এ যেন ঠিক এক বহু-ব্যক্তিত্বময়ী নারীর ওঠাপড়ার কাহিনী- ঘর, সংসার আর বহির্জগতে যাঁর গতি অপরিসীম, ঠিক যেমন তিনি লিখেছিলেন তাঁর ছোটগল্প 'মালতি'-তে। এক রিটায়ার্ড প্রফেসরের স্ত্রীর প্রেম, সুসংবদ্ধ জীবন, তারপরেই আকস্মিক পরকীয়ার হাতছানি, এবং দুটি পুরুষের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েও যিনি শেষ পর্যন্ত বেছে নেন সাংসারিক স্বাধীনতাকেই। লীলাবতীর নারীরা, তাঁর গল্পের চরিত্ররা, নাটকের পরিমণ্ডল- এগুলি সবই সাধারণের মধ্যে থেকেও অসাধারণের প্রতি নিবিষ্ট, কোনো নেতিবাচক বহির্বিশ্বের শক্তি তাদেরকে ধূলিসাৎ হতে দেয়না। এইজন্যে লীলাবতী আধুনিক, এবং ভীষণভাবে ভারতীয়| লীলাবতীর মৃত্যু হয় ১৯৭৮ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী। পাঠকের জন্যে তাঁর বেশ কিছু লেখা সংকলিত আছে ‘জাভান নি বাটে’ (১৯৭৭) এবং ‘সঞ্চয়’ (১৯৭৫) এই বইগুলির মধ্যে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours