মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:
সময় ছুটে চলেছে দ্রুতগতিতে। সেই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও ছুটছি।
বদলে যাচ্ছে জীবনের চাহিদা, সেই সাথে বদলে যাচ্ছে চেনা পথের বাঁকগুলো । ভোগবাদী জীবনে আরো বেশি চাহিদার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছি এক অন্ধকার জগতের সাথে। সে জগত অন্য কোথাও নেই। তা আছে আমাদের মনের ভেতর। তা হোল একাকীত্ব। একাকীত্ব খুব সহজেই মনে অবসাদ আনে। সেই অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে আজকাল আট থেকে আশি , সব বয়সের মানুষ কম বেশি নিজেকে নানা রকম ভিডিও গেমে ব্যস্ত রেখেছে।
এইসব গেমের অধিকাংশই কিন্তু অ্যাকশন গেম। যেখানে একে অপরকে মেরে পয়েন্ট পেতে হয়। কিছু গেম তো আবার মারাত্মক রকমের ভায়োলেন্সে ভরা। এরকমই একটি গেম হল পাবজি গেম। যা আজকাল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু কোরোনা ভাইরাসে থেকেও ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। কেন? তা বিস্তারিত বলার আগে একটু জেনে নি এই ভিডিও গেমের ব্যাপারে রিসার্চ কি বলছে।
বিভিন্ন নিউরোসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত বিভিন্ন রিসার্চের যে ফল পাওয়া গেছে তা সব এক। এই রিসার্চ অনুযায়ী এক থেকে দু ঘন্টা যেকোন ভিডিও গেম বিশেষত অ্যাকশন গেম খেললে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে। এমনকি এও দেখা গেছে যে , গেমারদের ফোকাসিং পাওয়ার অনেক বেশী হয় নন গেমারদের থেকে। সবচেয়ে অবাক করা ফল যেটা পাওয়া গেছে তা হোল এই নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত ভিডিও গেম খেলে ডিসলেকশিয়া রোগী দ্রুত সুস্থ হয়েছে। এতো গেল বিজ্ঞানীদের কথা। বাস্তবে সামাজিক ভাবেও এই সব গেমের প্রভাব আজকাল গভীরে ব্যপ্ত। ছোট পরিবারে মা বাবার তুমুল ব্যাস্ততার ফলে ছোটরা এই সব গেমের মাধ্যমেই নিজেদের বন্ধু খুঁজে নিচ্ছে। হোক না সে ভার্চুয়াল বন্ধু। সারাদিন পড়ার চাপে ক্লান্ত মন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে চায় বন্ধুদের সান্নিধ্যে । অথচ আজকাল বাচ্চারা খেলার সময়ই পায় না। মা বাবারা তাদের যে ইদুর দৌড়ে সামিল করতে চায় তাতে তারা আরও ক্লান্ত, একা হয়ে পড়ছে । আর তাই এই সব গেমগুলোকে তারা নিজেদের মানসিক চাপ কমাবার উপায় বলে ভাবছে। এই পাবজি গেমের কথাই ধরা যাক। এই গেম যে যার বাড়িতে বসেই বন্ধুদের সাথে খেলতে পারে। অডিও ভিসুয়াল সিস্টেম এর ফলে যেমন পাবজির মাধ্যমে চেনা অচেনা নানা মানুষ পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে তেমনি সারা বিশ্বের সাথেও যোগাযোগ হয়।
শুধু তাই নয় বর্তমানে এই গেমগুলোকে ‘ই স্পোর্টস’ তকমা দিয়ে ভারচুয়াল টুর্নামেন্ট পরযন্ত হয়। টাকাপয়সার লেনদেন চলে।গেমাররা অর্থাৎ যারা এই গেমে এক্সপার্ট , তারা এই গেম খেলাকে নিজের ভবিষ্যৎ পেশা হিসেবে গ্রহন করার কথাও ভাবে।
আর সমস্যা শুরু হয় ঠিক এইজায়গা থেকে। প্রথমে নিজের একাকীত্ব কাটাতে যে গেম খেলার শুরু হয় , ক্রমেই তা আসক্তিতে পরিনত হয়। এহেন খেলা এক দু ঘণ্টা খেলা ভালো তা যখন সাত আট ঘন্টা হয় তখন সেটা মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। গেমে আসক্ত ছেলেটি বা মেয়েটি তখন বাস্তব থেকে ক্রমশ বিছিন্ন হতে থাকে। আহার নিদ্রার মত ব্যাপার গুলো তখন তাদের কাছে অপ্রোয়জনীয় হয়ে পড়ে । ফল এক অসুস্থ জীবন।
তাঁর ওপর রয়েছে পাবজি বা অন্য গেম ওয়েবে স্ট্রিমিং করে টাকা রোজগারের হাতছানি। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এই প্রলোভনে পড়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলছে। ঠিক যেমন জুয়াড়িরা করে। পাবজি গেম এ আরো ভয়ানক ব্যাপার হোল , ঘন্টার পর ঘন্টা খেলে কেউ সরবোচ্চ লেভেলে পৌঁছও হঠাত যখন নিচে নেমে যায় তখন অনেকেই এই ধাক্কা সামলাতে পারে না। এই কারনে হার্ট ফেলিওর করে মৃত্যুর ঘটনাও জানা গেছে। যারা পাবজি বা অন্যান্য ভিডিও গেমে আসক্ত , তাদের আচার আচরনেও অসঙ্গতি ধরা পড়ছে। ভার্চুয়াল ঐ গেমেই নিজেদের মনকে বন্দী করে রাখার দরুন বাস্তব জগত থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। এক ধরনের মানসিক রুগীতে পরিনত হচ্ছে। ব্লু হোয়েল নামক গেমটি মানুষকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করত। এই পাবজি সহ অন্যান্য অ্যাকশন গেম মানুষকে জীবিত অবস্থায় তিলে তিলে মরনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পাবজির নেশায় কত পরিবার তাদের সন্তানকে চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখছে । শুধু তাই নয় এই গেম কিছু পরিবারের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্যও দায়ি। কর্মক্ষেত্রেও এই গেমের নেশা তাদের পিছু ছাড়ে না। ফলস্বরুপ চাকরী খোয়াতে হয়।
এইভাবেই সর্বনাশা ভিডিও গেম আমাদের সমাজকে নিশব্দে ধ্বংস করছে। এর থেকে মুক্তি পেতে গেলে যেমন সরকারকে কোন কঠিন আইন প্রনয়ন করতে হবে। তেমনি মা বাবাদেরকেও তাদের সন্তানের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। মা বাবারা নিজেদের আচরন সংযত করে যদি সহানূভুতির সাথে সন্তানের ইচ্ছাকেও গুরত্ত্ব দেন তবেই তারাও মা বাবাকেই বন্ধু হিসেবে দেখবে । আর মা বাবাকে বন্ধু পেলে এই সব গেমের নেশা আর আমাদের সমাজের মেধাকে নষ্ট করতে পারবে না। ভেবে দেখার সময় এসেছে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours