প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
একশত চিতার অগ্নি প্রতিফলন চোখে নিয়ে যন্ত্রণা নেই, শুধু একটাই অনুভূতি।  প্রতিশোধের স্পৃহা ধ্বংসলীলার বুকে আরো এক সংযোজন, কুন্তী। আত্মজারূপে যাকে বুকে করে এনেছিলেন কুন্তীভোজ, অগোচরে অন্তঃপুরে স্থগিত করে, আজ লজ্জার তকমা ছাড়িয়ে রাজনীতিবোধের গুণ সমাদর। সূর্যের আকৃতি অঙ্কিত, জাজ্বল্যমান ত্বকের এমন আবরণী আজ স্নেহের চোরাস্রোতে হৃদয় সিক্ত করে মর্যাদার স্খলন করেছে৷ তাই তাকে তো আর রাখা যায় না। উত্তরসূরী তো পরিচয়ের সামগ্রী, তবু তো পথের বুকে এলে সরিয়ে ফেলতেই হয়। বিসর্জন সেদিনও ছিলো আছে, আজও আছে । প্রতাশা তো অনুমতি মানে না, তাই সহস্বযোজব কক্ষপথে প্রক্ষিপ্ত আধার ধরেই চলা৷ 

পান্ডুর সঙ্গে শকুনির তখন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। এখানেও কুন্তীর চোখে জল, আর সহ্য হয় না শকুনির৷ তিনি বিমর্ষ হয়ে উঠলেন। আবার এখানেও মাদ্রী আসছেন। মদ্রদেশের রাজকন্যা নাকি " অপ্সরানিন্দিত সুন্দরী "। স্নেহপরশ তখন বিহ্বল হলো শকুনির প্রাণে৷ সেদিন মানসকর্ণ কথা বলল ধৃতরাষ্ট্র হয়ে, " গান্ধারী, মনে রেখ, কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রের জননী কিন্তু তোমাকেই হতে হবে। " তবে কি এখানেও অসমবিবাদ৷ সবকিছুই কি পূর্বপরিকল্পিত। একাধিক বিবাহে কুন্তী কি করে সয়ে নেবে এই নহবত, এই মন্ত্রোচ্চারণ, শকুনির মতো মানুষও কেঁদে ফেললেন৷ যাদব, মদ্রদেশ আজ কুরুরাজ্যের অধীন৷ কেবল তাহলে বাকি রইল গান্ধারবাসীর রক্তের সংকল্প৷ গান্ধার পিছিয়ে গেলো অজ্ঞাত সময়সীমায়। এতো চোখের জলের মাসুল দিতে হবেই ভীষ্মকে৷ শকুনি পিতা সুবলের অস্ত্রনির্মিত পাশা বার করলেন। মৃত পিতার নামে শপথ করলেন, বিবিধ ক্ষুদ্র জনপদের উপর ক্ষমতাপ্রদর্শনের এই প্রস্তরবৎ সিদ্ধান্তকে ভাঙতেই হবে৷ 

বিবাহমণ্ডপের দিকে তাকিয়ে আজ আর শকুনির সেই আসর সৌন্দর্য মনে এলো না। কুন্তীর মুখ সামনে ভেসে  এলো।  বাসুদেব ভগ্নী আর যাই হোক তাঁর শত্রু তো নন। এক নারীর প্রিয় ভ্রাতা যে তিনি নিজেও, তা ভুলবেন কি করে৷ নারী যদি দেখে, তাঁর স্বামী দ্বিতীর বার পাণিগ্রহণ করছেন, সেই নারী কি চুপ করে থাকতে পারে৷ শরীর জুড়ে যার আঘ্রাণ, সেই সোহাগ কুড়িয়ে নিচ্ছে আরো একজন। যৌনতায় কি আসে যায়৷ ভ্রুণের কাছে ঐটুকু সময় ছেড়ে ভালোবাসার একরাশ আদরের বুকে এ কেমন দৈন্যতা, তা বুঝতে দেরী কি হয়!  নিজেও তো সন্তানের পিতা ; অন্ধের হাতে ভগ্নীজে সঁপে নিজেও তো কেঁদেছেন৷ এক নারী কি সইতে পারে, যে, অভিমানের ঝুড়িটা আজ দুই ভাগ হবে! কোন নারী সবটুকু দিয়ে কি সইতে পারে কেউ তার স্বামীর দেহে রঙ এঁকে দেবে! গালে গাল ঠেকিয়ে সেই পুরুষ যখন আরো একটা জীবনকে মুঠি ধরে বলবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি " আবার এক অঝোর কান্নার ভূমি প্রস্তুত করবে, নতুন ভাবে, নতুন মোড়ে। বাঁক পরিবর্তন হয়ে যাবে, তবু সোহাগের রাতে যন্ত্রণার অনুভব কি সেই পুরুষ নেবে!!  বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে বাবা তুলে দেবে, রাজনীতি রাখতে পালিত বাবা তুলে দেবে, তবু তাকে নাকি মহিষী হতে হবে। 
শকুনির মুখে " ভগিনী কুন্তী " শব্দবন্ধটি শুনে আকুল হয়ে বললেন " আমি কোন পাপে পাপী ভ্রাতা! " কেন বার বার আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়!  আমার মাতৃত্ব বিসর্জন হয়, পতি ভাগ হয়ে যায়, কেন!  কেন!  " শকুনি হতবাক ; এমন শোকের মুখে কুন্তী যে নিজের গোপন কথা বলে ফেলবেন তা শকুনি ভাবতেও পারেন নি। শকুনি, কুন্তী কে বললেন, ধীর " কুন্তী!  একটি বাক্যের জন্য আজ গান্ধারী নিঃশোষিত!  দ্বার, গবাক্ষ, অলিন্দ, প্রাচীর ভীষ্মের অনুচর।অনুরোধ করি ভগিনী শান্ত হও " গান্ধারীর শৈশবে এক অজশিশুর সাথে বিবাহ হয়। তা কেবল বিবাহদোষ কাটানোর জন্য। তারপর সেই অজশিশুকে হত্যা করে ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। তা জানতে পেরে গান্ধারের শ্রী আজ নিশ্চিহ্ন। আত্মীয় - পরিজন আজ অন্ধকুঠুরিতে অভুক্ত।  আজ কুন্তী যদি নীরব না হন, তবে কুন্তীভোজের শ্রী শেষ হবে৷ তাই স্থির, নিশ্চুপ হতে শকুনি আদেশ করলেন। সে নাকি কাল!  তবে শকুনি এক নারীর এতো যন্ত্রণার দিনে তাকে সান্ত্বনা দিলেন!  পাশার চালে তো কোথাও পাণ্ডু, কুন্তী নেই তবে রক্তে রঞ্জিত গান্ধার কি তাকেই কটাক্ষ করবে!  

সময় তো আপন খেয়ালে চলে ; শকুনি জানতেন পাণ্ডুর অক্ষমতার শরনিক্ষেপ করে, আচ্ছাদিত করার বুদ্ধি কেবলমাত্র কুন্তীর। আর তাই কিন্দম মুনির ধারণা। কিন্তু আগামীতে তো গান্ধারীকে গর্ভবতী করে জিতিয়ে দিতে হবে। সুচারুরূপে শকুনি রটিয়ে দিলেন "একশত পুত্র, তাই গর্ভধারণের সময়কাল দীর্ঘ "।  নিয়ে এলেন গান্ধারে। এদিকে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র যেন অনভিপ্রেত শকুনির কাছে৷ কিন্তু, এতিমধ্যে ঘটে গেছে অঘটন ; গান্ধারী গর্ভপাত হয়ে গেছে৷ শকুনি দেখলেন আজ যদি বৃথা আস্ফালন করেন তবে, যে প্রতিশোধের বীজ অঙ্কুরেই শেষ হবে৷  তাই বেদব্যাসকে স্মরণ করলেন।

তারপরেই ঘৃতপূর্ণ কলসে সংগ্রহ হলো ভ্রূণ।  আসলে প্রেমের অমোঘ আকর্ষণে বিশ্বাস তো প্রতিস্থাপন হয় নি, তাই ভোগ্যপন্যের মতো করে তুচ্ছার্থে ভালোবাসা যেন মনসামঙ্গলের চাঁদসদাগরের চ্যাং মুড়ি কানি" মনে করিয়ে দেয়। জীবন যখন যান্ত্রিক ভ্রূণের সম্পদ করে শুধুই হাত পাতে, তখন আর ভালোবাসার প্রশ্রয় কোথায়! শকুনি অঙ্গদের সহায়তায় বেদব্যাসের আশীষ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবিত রাখলেন প্রতিশোধের  বীজ৷ পরম্পরা না এলে, তাকে ডাল পালা মেলে ভবির অনিষ্টের চিহ্ন গড়বেন কি করে, তাই কাঁটে দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে, শিক্ষা পেয়েছেন শকুনি। তবে সেদিন বিদুরের সতর্ক বাণী একা ছিলো না, প্রকৃতি সাক্ষ্মী দিয়েছিলো তরঙ্গ ভোগ করতেই হবে ভীষ্মকে। তছনছ হবে ধৃতরাষ্ট্র অহং। অম্বিকা অসম্মত হলেও, প্রকৃতি সূত্রাকারে মূর্তিমান অমঙ্গলকে এঁকে দিলেন, বীজ নয় উপলক্ষ্য পুঁতলেন শকুনি৷ ধ্বংস বীজ আবার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours