প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
ইতিহাস যখন কষ্টিপাথরে আসল নকল যাচাই করে, তখন নতুন যাচাই অলক্ষ্যে থেকে যায়। এটাই তো স্বাভাবিক; সংসারের মিষ্ট আকর্ষণ জুড়ে যে ভালোবাসারা সচরাচর কথা বলে, তখনই নাটকের মোড়ে দেখা যায় পর্বভেদ। এমন করেই, কুন্তীর জীবনে প্রাথমিকে রাজমাতার উচ্চাশা পূরণ হয়।কিন্তু এর মধ্যে যে ধৃতরাষ্ট্রের কপট অভিপ্রায় ছিলো তা মনে হয় কুন্তী আমলই দেন নি। আর বাৎসল্যের সুধাসিন্ধু মুখে জগদ্দল পাথুরে বুকটাও তো তরল হলো, তবু দুঃস্বপ্নেরা কেন এলো! আসলে নিশ্চিন্তের সলতে একা জ্বললে, ইতিহাসের ভয় হয়। ইতিহাস যে নিত্য নতুন ভ্রুণের সঞ্চার করে, সে কি স্মৃতির কুটিল অন্ধকার গহ্বরে সাপের ফণা ধরবে না! উফফ! নির্বুদ্ধিতার অভিসম্পাত যেন ভবিতব্যের ঘরে শিকড় চরিয়ে মাটি ফুঁড়ে উঠবেই। অচেনা দাবানলের রাঙা আলো ভীষ্মের বুকে আছড়ে এসে চরিত্রটাই পাল্টে দেয়।
আজ রাজনীতির গর্ভদেশে উত্তাপ পরোক্ষভাবে অপকর্মকে নীরবে অনুমোদন করেছেন। তবে কি শান্তনুর বঞ্চনাকে সংকল্প নিয়েই তিনি প্রতিশোধের অঙ্গারে উদ্ভাসিত হয়েছেন। বিরূপতা মিটে গেলেও ঈশ্বর কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের সহায় হলেন৷ মুখাপেক্ষীর জঠরে জীইয়ে রইল না ধৃতরাষ্ট্র, বরং চাতুরী তার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল রেখেছিল। যেদিন গঙ্গাকে সমর্পণ করা হয়েছিল, সেদিন অনুরাগ বা প্রেম কোনটাই ছিলো না। চোখের ক্ষুধা আর ভোগের বাসনা ছাড়া কিছুই ছিলো না। আরে বাবা! ভোগ আর ভোগ, ক্লান্তি তো আসবেই৷ তখন নাকি উচ্ছিষ্টের মতো সেই ভোগের স্থান হবে আবর্জনায়৷ সেদিন অনার্যদলনকারী অসুরের কাছে সমর্পণ ছাড়া তো আর কোনো পথ শোভা পায় না৷ এরপরের ঘটনাই কি ভীষ্মকে বিবেকের আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্বের উপহার দিয়েছিলো।
যুধিষ্ঠির ও অর্জুন ছিলেন ভীষ্মের ফুসফুস ও হৃদয়।তাদের সান্নিধ্যে তিনি পেতেন নতুন প্রাণ। তিনি বলতেন "প্রাণ আমার! বন্ধু আমার!" আচ্ছা! নিরপেক্ষ হতে গেলে কি নিরাসক্ত হতে হয়! আসলে বিশ্বাসই তো সব। বিশ্বাস ভেঙে গেলে সবটুকুই নড়বেড়ে হয়ে যায়৷ ভরে ওঠা পবিত্র সুখে দানই হৃদয়কে বড়ো করে দেখিয়ে দেয়। ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে বহুবার, কিন্তু ভাগ্যচক্রের পরিধিটা বিস্তৃত। জীবন তো আনুভূমিক অনুভূতির জোয়ার, উপলব্ধি তাকে স্পর্শ করে যায় । কোথাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাভোগের পথে অনুগত ও বাধ্য পঞ্চপাণ্ডব যে প্রতিবন্ধক, তা মনে হয় বলে দিতে হয় না৷ আর সেখানে ভীষ্ম রাজনৈতিক প্রাধান্যতে মশগুল থেকেছেন; গুমরানো আঁচের আগুনে কুন্তী যেন আগুনে দগ্ধ মাদ্রীর আর্তনাদ শুনেছেন। মনে মনে বলেছেন, ইতিহাস সৃষ্টি করতে হলে আত্মবলি দিতে হয়। তবেই তো বিজয়কেতন ওড়ে, অনন্তকাল ধরে। (ক্রমশঃ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours