সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
গবেষণা কিন্ত গবেটিয় ব্যাপার নয়। এর পরিধিও কম নয়। একদল পাগল মানুষ কিসের নেশায় কি কি খুঁজছেন আর খুঁজছেন। তবে এই পাগল মানুষ গুলোর জন্যই হয়ত আমরা সবজান্তা ভাব দেখায়। এই পাগল অনুসন্ধানীদের জন্যই বিজ্ঞান আজ মধ্য গগনে, তারই সুবাদে আজ আমরা কেমন যেনো নিজেদের জ্ঞানটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে পারি। ওই দেখো রাগ করছেন কেন? গ্যালেলিওকে পাগল আর ষড়যন্ত্রকারী বলে অন্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো সত্য সেটাই তা প্রমাণিত হলো যে সূর্য্য স্থির পৃথিবী সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরছে। হয়ত আজ এটাও পাগলামি মনে হতে পারে, কি জানি তবে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত করে বলেননি। তবে গবেষণা যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে কোভিডের সঙ্গে প্যাঙ্গোলিনের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাই যদি হয়, তা হলে এটা হবে প্রকৃতির চরম প্রতিশোধ। সাতে-পাঁচে না থাকা এই নিরীহ প্রাণীটিকে যে ভাবে নিঃশেষ করতে করতে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়েছে মানুষ, ঠিক সেই পথে সে-ও যেন মানুষের অবলুপ্তি করতে চাইছে।
কে এই মহাশয় প্যাঙ্গোলিন? কোথায় মহাশয়ের নিবাস ? কোভিডের বা করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে আমরা তো তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা করিনি! কেন তাকে মারা হয়েছে? আসুন, ভাইরাসের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সে সব এক বার জেনে নেওয়া যাক।
প্যাঙ্গোলিন হল কুমিরের মতো দেখতে, নিতান্ত নিরীহ ছোট্টখাট্টো বিড়ালের মাপের এক প্রাণী। কিছু প্রজাতি অবশ্য বড়সড়ও হয়। শক্ত শক্ত আঁশে ঢাকা শরীর, বিপদে পড়লে যার সাহায্যে আত্মরক্ষা করে সে। দেখে সরীসৃপ মনে হলেও আসলে স্তন্যপায়ী প্রণী। একসঙ্গে গোটা তিনেক পর্যন্ত সন্তানের জন্ম দিতে পারে। তার পর পরম মমতায় প্রায় দু-বছর ধরে লালনপালন করে তাদের বড় করে তোলে। থাকে চিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আফ্রিকার কিছু বিশেষ অংশের জঙ্গলে। গাছের কোটরে, মাটির নীচে বা ঘাসজমিতে লুকিয়ে, কারণ সে একা থাকতেই ভালবাসে। প্রজননের সময় ছাড়া কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। রাতভর ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে। লম্বা আঠালো জিভটা মেলে দেয়, তাতে পিঁপড়ে, উই, লার্ভা, পোকামাকড়, যা এসে লাগে তাতেই পেট ভরায়। তো এই হল প্যাঙ্গোলিন। কিন্তু কেন তাকে নিঃশেষ করা হচ্ছে?
আসছি সে প্রসঙ্গে। তবে আগে কয়েকটা হিসেব দেখে নিন, তা হলে বুঝতে পারবেন, কী ভাবে তাদের ধ্বংস করা হচ্ছে। বছরে প্রায় এক লাখ প্যাঙ্গোলিন পাচার হয় চিন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে। খবর থেকে জানা যায়, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে প্রায় ৯ টন প্যাঙ্গোলিনের আঁশ আটক করা হয় হংকংয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই পরিমাণ আঁশ পেতে গেলে কম সে কম ১৪ হাজার প্রাণীকে মারতে হয়। পরের মাসে মালয়েশিয়াতে বাজেয়াপ্ত হয় ৩৩ টন মাংস। আবার এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়ে ১৪ টন আঁশ।
ছুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা, এ তো চার মাসের হিসেব। যতটুকু ধরা পড়েছে তার হিসেব। যা নিরাপদে পাচার হয়ে গিয়েছে বা যায় তার কোনও হিসেব নেই। বছরের পর বছর যে ধ্বংসলীলা চলছে, তারও হিসেব নেই কোনও। চিনে নাকি এই চোরাচালান নিষিদ্ধ। কিন্তু উহানের বাজারে যে কি বিপুল পরিমাণে প্যাঙ্গোলিনের মাংস বিক্রি হয়, তা সবাই জানেন। সবার চোখের সামনেই চলে বিকিকিনি।
কিন্তু কেন চলে? চলে কারণ চিন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই মাংস হল ডেলিকেসি। স্ট্যাটাস সিম্বল। প্যাঙ্গোলিন স্টার ফ্রাই ইত্যাদি পদ যাঁরা খেতে পারেন তাঁরা চিহ্নিত হন উচ্চবর্গের মানুষ হিসেবে। বাড়িতে অতিথি এলে অভ্যর্থনা হয় এ সব খাবার দিয়েই। সে জন্যই এর দাম দিনে দিনে উর্ধ্বমুখী। ১৯৯০ সালে যেখানে এক পাউন্ড মাংসের দাম ছিল ৭ ডলার, এখন তার দাম ৩০০ ডলার।
তার উপর রয়েছে আঁশের বাজারদর। প্যাঙ্গোলিনের আাঁশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে বানানো হয় ট্র্যাডিশনাল চিনা ওষুধ। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এই ওষুধ দোকানে তো পাওয়া যায়ই, পাওয়া যায় অনলাইনে অর্ডার করলেও। অধিকাংশ চিনবাসী বিশ্বাস করেন, এই ওষুধের অদ্ভুত গুণাগুণ আছে। সে পারে না হেন কাজ নেই। বাচ্চা কেঁদে কেঁদে হয়রান হলে যেমন এই ওষুধ কাজ করে, কাজ করে ত্বকের রোগে, না-সারতে চাওয়া ঘায়ে। বুকে দুধ আসছে না? মা-ঠাকুমার পরামর্শ, খেয়ে নাও প্যাঙ্গোলিনের আঁশের গুঁড়ো দিয়ে বানানো ওষুধ। বাতের ব্যথায় ঘুম নেই? এটাই খাও। হাঁপানির টান? খাও। ক্যান্সারে? অবশ্যই। এ তো ক্যান্সারও সারাতে পারে!
কি ফালতু বলছেন, বিশ্বাস হল না নিশ্চয়ই! হওয়ার কথাও নয়। কারণ আাঁশে কেরাটিন ছাড়া আর কিছু নেই। বা যদি থাকতও, এক ওষুধের এত কেরামতি হওয়া সম্ভব হত না। অতএব ওষুধ হিসেবে বিজ্ঞানের ঘরে কোনও ঠাঁই নেই তার। কিন্তু তাতে যে ব্যবসায় ভাটা পড়েনি, উপরের হিসাবগুলিই তার প্রমাণ। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, মালয়ান প্যাঙ্গোলিন কমতে কমতে ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফিলিপিনো ও ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন হয়ে গিয়েছে অর্ধেক।
আর এই সব কু-কাজ ও অন্ধবিশ্বাসের ফলেই আজ ভুগছে গোটা পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্যাঙ্গোলিন কাটা, আঁশ ছাড়িয়ে গুঁড়ো করা, ওষুধ বানানো, তার মাংস খাওয়া ইত্যাদির অবসরেই সম্ভবত ভাইরাস ঢুকেছে চিনাদের শরীরে। সেখান থেকে ছড়িয়েছে বিশ্বময়। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টমি ল্যাম জানিয়েছেন, চিনে পাচার হওয়া মালয়ান প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে এমন দু’টি করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক মিল রয়েছে।
সব বিশেষজ্ঞ অবশ্য এর সঙ্গে একমত নন। ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে তাঁরা জানিয়েছেন, ভাইরাসের চরিত্রে মিল আছে বলে যে মালয়ান প্যাঙ্গোলিন থেকেই মানুষের শরীরে রোগ ছড়িয়েছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, বাদুড়ের ভাইরাসের সঙ্গেও নভেল করোনা-র মিল আছে। একটু বরং বেশিই আছে। আবার অমিলও আছে। কাজেই এমনও হতে পারে, তৃতীয় কোনও প্রাণীর হাত ধরে বিপদ এসেছে। বা হয়তো তিনে মিলেই অঘটন ঘটিয়েছে। তবে ঠিক কী ভাবে ভাইরাসটি একের শরীর থেকে অন্যের শরীরে, তার পর মানুষের শরীরে ঢুকলো, তা এক বিরাট রহস্য। কেউ মনে করেন, যখন প্যাঙ্গোলিন পাচার হচ্ছিল, সেই সময় হয়তো আশপাশে থাকা বাদুড় থেকে তার শরীরে ঢুকেছে ভাইরাস। আবার কারও মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গলেই ঘটেছে কাণ্ডটি।
লন্ডনের জুলজিক্যাল সোসাইটির অধ্যাপক এন্ড্রু কানিংহ্যাম জানিয়েছেন, এ নিয়ে গবেষণা ও চাপানউতোর চলছে বিস্তর। তবে প্যাঙ্গোলিন যে কোনও না কোনও ভাবে এই রোগের সঙ্গে যুক্ত, তা নিয়ে তেমন সন্দেহ এখন আর নেই।
তবে একটাই সুখবর। বিশ্বজোড়া এই বিপর্যয়ের পর চিন এই সব অখাদ্য-কুখাদ্যে রাশ টানতে চলেছে। ভিয়েতনামও চলেছে একই পথে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র সুফল হিসেবে বেচারা প্যাঙ্গোলিনরা নিঃশেষ হওয়ার হাত থেকে বাঁচে কিনা?
আবারও নীতিবুলি বলেই ফেলি মানুষের বিলাসিতায়, তার অপ্রকৃতিক ব্যবহার ও সৃষ্টিই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছে। আচ্ছা আমার জীবনটাই কি শেষ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি এই অন্ধকার কুসংস্কার নিয়েই বেঁচে থাকবে আর আরও দ্রুত ধংসের দিকে এগিয়ে যাবে? প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে আর উত্তর নিজেকেই লিখতে হবে ধংসের ভবিষ্যৎ প্রতিচ্ছবি। আবারও ভাবুনতো এই গৃহবন্দী দশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে প্রকৃতির বন্ধু হয়েই চলতে হবে। শত্রুতার ফল ভয়ংকর।
গবেষণা কিন্ত গবেটিয় ব্যাপার নয়। এর পরিধিও কম নয়। একদল পাগল মানুষ কিসের নেশায় কি কি খুঁজছেন আর খুঁজছেন। তবে এই পাগল মানুষ গুলোর জন্যই হয়ত আমরা সবজান্তা ভাব দেখায়। এই পাগল অনুসন্ধানীদের জন্যই বিজ্ঞান আজ মধ্য গগনে, তারই সুবাদে আজ আমরা কেমন যেনো নিজেদের জ্ঞানটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে পারি। ওই দেখো রাগ করছেন কেন? গ্যালেলিওকে পাগল আর ষড়যন্ত্রকারী বলে অন্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো সত্য সেটাই তা প্রমাণিত হলো যে সূর্য্য স্থির পৃথিবী সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরছে। হয়ত আজ এটাও পাগলামি মনে হতে পারে, কি জানি তবে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত করে বলেননি। তবে গবেষণা যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে কোভিডের সঙ্গে প্যাঙ্গোলিনের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাই যদি হয়, তা হলে এটা হবে প্রকৃতির চরম প্রতিশোধ। সাতে-পাঁচে না থাকা এই নিরীহ প্রাণীটিকে যে ভাবে নিঃশেষ করতে করতে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়েছে মানুষ, ঠিক সেই পথে সে-ও যেন মানুষের অবলুপ্তি করতে চাইছে।
কে এই মহাশয় প্যাঙ্গোলিন? কোথায় মহাশয়ের নিবাস ? কোভিডের বা করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে আমরা তো তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা করিনি! কেন তাকে মারা হয়েছে? আসুন, ভাইরাসের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সে সব এক বার জেনে নেওয়া যাক।
প্যাঙ্গোলিন হল কুমিরের মতো দেখতে, নিতান্ত নিরীহ ছোট্টখাট্টো বিড়ালের মাপের এক প্রাণী। কিছু প্রজাতি অবশ্য বড়সড়ও হয়। শক্ত শক্ত আঁশে ঢাকা শরীর, বিপদে পড়লে যার সাহায্যে আত্মরক্ষা করে সে। দেখে সরীসৃপ মনে হলেও আসলে স্তন্যপায়ী প্রণী। একসঙ্গে গোটা তিনেক পর্যন্ত সন্তানের জন্ম দিতে পারে। তার পর পরম মমতায় প্রায় দু-বছর ধরে লালনপালন করে তাদের বড় করে তোলে। থাকে চিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আফ্রিকার কিছু বিশেষ অংশের জঙ্গলে। গাছের কোটরে, মাটির নীচে বা ঘাসজমিতে লুকিয়ে, কারণ সে একা থাকতেই ভালবাসে। প্রজননের সময় ছাড়া কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। রাতভর ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে। লম্বা আঠালো জিভটা মেলে দেয়, তাতে পিঁপড়ে, উই, লার্ভা, পোকামাকড়, যা এসে লাগে তাতেই পেট ভরায়। তো এই হল প্যাঙ্গোলিন। কিন্তু কেন তাকে নিঃশেষ করা হচ্ছে?
আসছি সে প্রসঙ্গে। তবে আগে কয়েকটা হিসেব দেখে নিন, তা হলে বুঝতে পারবেন, কী ভাবে তাদের ধ্বংস করা হচ্ছে। বছরে প্রায় এক লাখ প্যাঙ্গোলিন পাচার হয় চিন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে। খবর থেকে জানা যায়, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে প্রায় ৯ টন প্যাঙ্গোলিনের আঁশ আটক করা হয় হংকংয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই পরিমাণ আঁশ পেতে গেলে কম সে কম ১৪ হাজার প্রাণীকে মারতে হয়। পরের মাসে মালয়েশিয়াতে বাজেয়াপ্ত হয় ৩৩ টন মাংস। আবার এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়ে ১৪ টন আঁশ।
ছুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা, এ তো চার মাসের হিসেব। যতটুকু ধরা পড়েছে তার হিসেব। যা নিরাপদে পাচার হয়ে গিয়েছে বা যায় তার কোনও হিসেব নেই। বছরের পর বছর যে ধ্বংসলীলা চলছে, তারও হিসেব নেই কোনও। চিনে নাকি এই চোরাচালান নিষিদ্ধ। কিন্তু উহানের বাজারে যে কি বিপুল পরিমাণে প্যাঙ্গোলিনের মাংস বিক্রি হয়, তা সবাই জানেন। সবার চোখের সামনেই চলে বিকিকিনি।
কিন্তু কেন চলে? চলে কারণ চিন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই মাংস হল ডেলিকেসি। স্ট্যাটাস সিম্বল। প্যাঙ্গোলিন স্টার ফ্রাই ইত্যাদি পদ যাঁরা খেতে পারেন তাঁরা চিহ্নিত হন উচ্চবর্গের মানুষ হিসেবে। বাড়িতে অতিথি এলে অভ্যর্থনা হয় এ সব খাবার দিয়েই। সে জন্যই এর দাম দিনে দিনে উর্ধ্বমুখী। ১৯৯০ সালে যেখানে এক পাউন্ড মাংসের দাম ছিল ৭ ডলার, এখন তার দাম ৩০০ ডলার।
তার উপর রয়েছে আঁশের বাজারদর। প্যাঙ্গোলিনের আাঁশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে বানানো হয় ট্র্যাডিশনাল চিনা ওষুধ। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এই ওষুধ দোকানে তো পাওয়া যায়ই, পাওয়া যায় অনলাইনে অর্ডার করলেও। অধিকাংশ চিনবাসী বিশ্বাস করেন, এই ওষুধের অদ্ভুত গুণাগুণ আছে। সে পারে না হেন কাজ নেই। বাচ্চা কেঁদে কেঁদে হয়রান হলে যেমন এই ওষুধ কাজ করে, কাজ করে ত্বকের রোগে, না-সারতে চাওয়া ঘায়ে। বুকে দুধ আসছে না? মা-ঠাকুমার পরামর্শ, খেয়ে নাও প্যাঙ্গোলিনের আঁশের গুঁড়ো দিয়ে বানানো ওষুধ। বাতের ব্যথায় ঘুম নেই? এটাই খাও। হাঁপানির টান? খাও। ক্যান্সারে? অবশ্যই। এ তো ক্যান্সারও সারাতে পারে!
কি ফালতু বলছেন, বিশ্বাস হল না নিশ্চয়ই! হওয়ার কথাও নয়। কারণ আাঁশে কেরাটিন ছাড়া আর কিছু নেই। বা যদি থাকতও, এক ওষুধের এত কেরামতি হওয়া সম্ভব হত না। অতএব ওষুধ হিসেবে বিজ্ঞানের ঘরে কোনও ঠাঁই নেই তার। কিন্তু তাতে যে ব্যবসায় ভাটা পড়েনি, উপরের হিসাবগুলিই তার প্রমাণ। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, মালয়ান প্যাঙ্গোলিন কমতে কমতে ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফিলিপিনো ও ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন হয়ে গিয়েছে অর্ধেক।
আর এই সব কু-কাজ ও অন্ধবিশ্বাসের ফলেই আজ ভুগছে গোটা পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্যাঙ্গোলিন কাটা, আঁশ ছাড়িয়ে গুঁড়ো করা, ওষুধ বানানো, তার মাংস খাওয়া ইত্যাদির অবসরেই সম্ভবত ভাইরাস ঢুকেছে চিনাদের শরীরে। সেখান থেকে ছড়িয়েছে বিশ্বময়। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টমি ল্যাম জানিয়েছেন, চিনে পাচার হওয়া মালয়ান প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে এমন দু’টি করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক মিল রয়েছে।
সব বিশেষজ্ঞ অবশ্য এর সঙ্গে একমত নন। ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে তাঁরা জানিয়েছেন, ভাইরাসের চরিত্রে মিল আছে বলে যে মালয়ান প্যাঙ্গোলিন থেকেই মানুষের শরীরে রোগ ছড়িয়েছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, বাদুড়ের ভাইরাসের সঙ্গেও নভেল করোনা-র মিল আছে। একটু বরং বেশিই আছে। আবার অমিলও আছে। কাজেই এমনও হতে পারে, তৃতীয় কোনও প্রাণীর হাত ধরে বিপদ এসেছে। বা হয়তো তিনে মিলেই অঘটন ঘটিয়েছে। তবে ঠিক কী ভাবে ভাইরাসটি একের শরীর থেকে অন্যের শরীরে, তার পর মানুষের শরীরে ঢুকলো, তা এক বিরাট রহস্য। কেউ মনে করেন, যখন প্যাঙ্গোলিন পাচার হচ্ছিল, সেই সময় হয়তো আশপাশে থাকা বাদুড় থেকে তার শরীরে ঢুকেছে ভাইরাস। আবার কারও মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গলেই ঘটেছে কাণ্ডটি।
লন্ডনের জুলজিক্যাল সোসাইটির অধ্যাপক এন্ড্রু কানিংহ্যাম জানিয়েছেন, এ নিয়ে গবেষণা ও চাপানউতোর চলছে বিস্তর। তবে প্যাঙ্গোলিন যে কোনও না কোনও ভাবে এই রোগের সঙ্গে যুক্ত, তা নিয়ে তেমন সন্দেহ এখন আর নেই।
তবে একটাই সুখবর। বিশ্বজোড়া এই বিপর্যয়ের পর চিন এই সব অখাদ্য-কুখাদ্যে রাশ টানতে চলেছে। ভিয়েতনামও চলেছে একই পথে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র সুফল হিসেবে বেচারা প্যাঙ্গোলিনরা নিঃশেষ হওয়ার হাত থেকে বাঁচে কিনা?
আবারও নীতিবুলি বলেই ফেলি মানুষের বিলাসিতায়, তার অপ্রকৃতিক ব্যবহার ও সৃষ্টিই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছে। আচ্ছা আমার জীবনটাই কি শেষ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি এই অন্ধকার কুসংস্কার নিয়েই বেঁচে থাকবে আর আরও দ্রুত ধংসের দিকে এগিয়ে যাবে? প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে আর উত্তর নিজেকেই লিখতে হবে ধংসের ভবিষ্যৎ প্রতিচ্ছবি। আবারও ভাবুনতো এই গৃহবন্দী দশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে প্রকৃতির বন্ধু হয়েই চলতে হবে। শত্রুতার ফল ভয়ংকর।
Post A Comment: