শ্রীতন্বী চক্রবর্তী, অধ্যাপিকা ও ফিচার রাইটার, কলকাতা:

পয়লা বৈশাখের বেরাদরিতে কাঁচি চালানো মানেই অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে আসে বল্কলহীনভাবে, যেগুলোর উত্তরগুলো প্রায়শই অজানা। দিন উদযাপন, নাকি রং-বিলাসের বর্ণিল প্যালেটে স্থবির সময় সংরক্ষণ? স্মৃতির সরণি বেয়ে পিছলে পড়া বেশ কিছু মুহূর্তের অভিমুখ আবার নতুন করে আবিষ্কার করা? নাকি শুধুই তিক্ততা রিক্ততার কিছু সার্বিক প্রযুক্তিগত আদানপ্রদান? নববর্ষ বলতে আমরা এখন, এই মুহূর্তে ঠিক কি বুঝি? কবির গানের বিলম্বিত লয় ফিরিয়ে নিয়ে যায় হয় নবান্নের এক ঝলকে হৃষ্টপুষ্ট খিদের চেহারাতেই, রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক ভাষায় বৈশাখকে আলিঙ্গন করে নেওয়ায়, কখনো বা নজরুলের ভাষায় 'প্রলয়োল্লাসে', আবার তার ঠিক পরের মূহূর্তেই অত্যন্ত গভীর, আত্মিক ব্যঞ্জনার সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যতিক্রমী জীবনের দার্শনিক-কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প 'অঘ্রাণে অন্নের ঘ্রাণ', গল্পের কথা, যেখানে, চিরুণী নাম্নী এক কিশোরী তার মাসির ঘরে নবান্ন খেতে গিয়ে গ্রামের ধনহরি মোড়লের লালসার স্বীকার হয়।এক অচেনা মুন্সী কিশোরীটিকে রক্ষা করে, এবং তারপর সে আবার মাসির বাড়ি যেতে উদ্যত হয়, সেই নবান্ন খেতে। খিদে প্রকারান্তরে অন্যরকম রূপ নেয়, নবান্নও, বুভুক্ষু মানুষগুলোও। নববর্ষের বিষয়টা, দিন, তারিখ, মাসের পালাবদল অতিক্রম করে কখন আপনাআপনিই হয়ে ওঠে লাগামছাড়া স্রোত-বন্ধ মুহূর্ত-যাপনের আখ্যান।

পয়লা বৈশাখ পালন করার উপকরণ বদলেছে, সম্ভাষণ, গতি-প্রকৃতি, মানুষের সার্বিক মানসিক গঠন, চিন্তাভাবনার পরিব্যাপ্তি, এই সবকিছুই নিতান্ত আত্মিক আদানপ্রদান বা কিছু অবেলার কাব্যিক ছন্দের মধ্যে আজ আর সীমাবদ্ধ নেই।খুব সহজভাবে বলতে গেলে, চিন্তামুক্তি, নৈরাশ্য, উৎকণ্ঠা, এই সবকিছুই বোধহয় একদা-সুবিবেচক সমাজকে হিসেবের দাঁড়িপাল্লায় রক্ষণশীল বানিয়ে দিয়েছে। কাজেই মঙ্গল-শোভাযাত্রা, গাজীর গান, ভাওয়াই, ভাটিয়ালি, প্রেম-বৈশাখের আলোড়ন তোলা কবিতাগুলি কোনো না কোনোভাবে এখন অনেকটাই প্রযুক্তিগত এবং কারিগরিবিদ্যার দৌলতে বিভিন্ন ভিডিও চ্যানেল, এসএমএস এবং মুঠোফোনের ঐন্দ্রজালিক আকর্ষণের বিষয়বস্তু ছাড়া আর হয়তো কিছুই না। কোডিং, ডিকোডিং, সেন্ডিং, আর রিসিভিং, তার সাথে ভীষণভাবে তৈরী হয়ে চলেছে নববর্ষের প্যারালাল গল্প এবং সমসাময়িকতা।
এটার আবার বহুবিধ দিক আছে- এখানে যুক্তি-তক্কের-ভাবপ্রবণতার 'ম্যাপিং' অথবা 'কার্টোগ্রাফি' অনেকাংশেই সাংস্কৃতিক মানচিত্রনির্মানবিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত; প্রতিনিয়ত বর্ডার, কাঁটাতার, জাতি, শ্রেণী-বৈষম্য ইত্যাদি হয় বড্ড বেশি প্রকট হয়ে উঠছে, নয়তো, সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপের মাধ্যমে ভাষা-পরিচয়-চেতনা আরো বেশি হতবুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ফেলছে কিছু কিছু জায়গায়। কলকাতা, আসাম, মিথিলা, তামিল নাড়ু, ত্রিপুরা, ঢাকা, চট্টগ্রাম,  স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রাম, শহর, মফঃস্বল এই সবগুলিই হয়ে ওঠে ভাষা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আত্মিক সংযোগস্থাপনের এক বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি। দক্ষিণ এশিয়ার স্বতন্ত্র এবং স্বাবলম্বী দেশগুলিতে ছাড়াও কানাডার বেশ কিছু জায়গায় সাড়ম্বরে পালন হয় বাংলা নববর্ষ।এই 'ভাষা' বা 'জবানী' পরিবর্তনের ফলে যেটা বহুচর্চিত এবং বেশ কিছু সময়ে অতিরঞ্জিতও হয়ে উঠছে), তা হলো একটি  'স্পেসিফিক স্পেস' বা নির্দিষ্ট কোনো 'স্থান' বলতে এখন আর কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা আমরা। স্থান, কাল, সময়, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল খুব অদ্ভুতভাবেই, পথ চলার ভুলভুলাইয়াতে আকবরের নববর্ষের ক্যালেন্ডারের সাথে বাঙালি পঞ্জিকা, বাংলাদেশী গান, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের অমোঘ হাতছানি এবং আন্তর্জাতিক (আন্তর্জালিকও বটে!)বাঙালির নববর্ষের উপাদানগুলি যথাযথভাবেই মিশিয়ে দিচ্ছে। ঠিক যেমনভাবে উৎকৃষ্টতার পরিমাপে আমরা দস্তুরমতো বেছে নিই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা এবং ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাসের একাধিকত্ব, ঠিক তেমনিই লালজামা-হালখাতা, কড়াপাকের মিষ্টি, মোল্লারচকের দই, লাল-পাড় সাদা শাড়ী আর স্বস্তিক এবং আরো বিভিন্ন মাঙ্গলিক চিহ্ন আজও অবিকল একরকম থেকে যায় আমাদের মননে, চিন্তায়, অবচেতনে বলে ওঠে,

"তুমি, হে নতুন দিন, দাঁড়িয়েছে সময়ের বাঁকে,

তোমাকেই ভোট দেবো, এ বছর পয়লা বৈশাখে!" (কবি শ্রীজাত )

নববর্ষ সেই কাঙ্খিত নতুন দিন, নতুন মুহূর্ত অমলিন থেকেই যায়, ভাষা বদলায়, দ্যোতনা বদলায়, কবিতার সাবালকত্ত্ব নিয়ে অকেজো রাহাজানি হয় সময়ের, কিন্ত তবুও কোথাও নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে এক বিকেলের ক্র্যানবেরি রোদে ঝলকানো এক মুঠো পলাশের রক্তগৈরিক বিচ্ছুরণ।

প্রচ্ছদ ছবিটি করেছেন দুর্গাপুরের ফিচার রাইটার চন্দন ভৌমিক

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: