প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

নারীর বুকে সতীন নামক কাঁটাটা কোথাও অপ্রত্যাশিতভাবে উথলা নদীর নিরাশ্রয়ের সমব্যথী বুক, এমনই তো হয়েছিল কুন্তীর জীবনে। নরম বালিশে মাথা গুঁজে অভিমানের নিঝুম কান্না। এক অদ্ভুত শূন্যতা।  বিদুর সেই সময় ঔৎসুক্য লজ্জা ; হ্যাঁ, পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহ তো ঝড়ের দোলন। স্বাতন্ত্র্যবোধে মিশে যায় যখন মূল্যায়নের পুরুষ, তখন কি আর খুব দোষী করা যায় হৃদয়কে!!  নিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা, কর্তব্যজ্ঞান, বিদুরের দিকে তাঁকে তো ঠেলবেই। মনের ঘরে মন না দিলে এমন প্রাণবন্ত আলাপচারিতা তো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাই নৈরাশ্যের বিচ্ছিন্নতা সংবেদনশীল হয়ে এক পুরুষের নিবিড় মনোযোগ কেড়ে নিলো৷

পাণ্ডুর কাছে কি পেয়েছে কুন্তী!  প্রেম, দরদ, সাহচর্য,  আনন্দ, আশ্রয় পাবে, এটাই তো চেয়েছিল সে..  কিন্তু কোথায় সে আবেগ!  স্বপ্ন তো স্মৃতিতে জড়ো হয়ে বহু যুগ ধরেই। কিন্তু প্রাণের মানুষটা বহু দূরে সরে গেছে৷ আশ্রয় দিলেই তো ভালোবাসা হয় না, দুঃখের বন্ধু, সান্ত্বনার বুক  সেটাও তো থাকবে!  বিবেক মনের গহীনে সম্পর্কের বাঁধে থাকুক, বাধ্যতা নয়; বিদুর সেই মুগ্ধ পুরুষ।

অপ্রাপ্তির পাল্লাটা যতোটা ভারী হয়েছে, বিদুর ততই শান্তির বুকে সম্পর্কের বাঁধন গড়েছে৷ বিদুর তো পুরুষ, তাই বুঝেছেন  দর্পণে মুখ মিথ্যা বলে না। বিষন্নতা ছেয়ে গেছে বহুবার শীতল শরীরে। কুন্তী বাসনার আগুনে বিদুরকে বললেন, সময়ের সাপেক্ষে শরীর শরীরকে চায়। একাকীত্ব নিঃস্ব করেছে অনুভূতির নারী জীবন। তারপরেই আচ্ছন্নের বুকে সঁপে দেয় জীবনের সব রঙ।
বিদুর বললেন, শূরসেনের কি বহু পত্নী নেই!  বুকের আগুন যদি চোখের জলে নিভে যায়, তাহলে হেরে যাওয়া অপমানের প্রতিকার হবে কি করে!  কাজ তো আরম্ভের নির্দেশে এসেছে৷ দুর্ভাগ্যের মেঘ তো চিরস্থায়ী নয়৷ ঝড় তো কুন্তীর জীবনে একার নয়,  ভেঙে তছনছ করেছে  বহুবার ;

নিষেধের অনুশাসনে নিয়ম বেঁধেই তো চোখ খোলার প্রত্যাশা। বিদুর বলেছেন,  দিগন্তের কোথাও লুকোচুরি নেই, সবটুকুই উন্মুক্ত। বাজীকরের হাত তো নিপুণ পরিচালনা চেনে,  তাই চমৎকারের সুরাহা তিনিই জানেন। কুন্তী সকল সুতোয় ঝুলোনো পুতুল। ইচ্ছার নদীতে হাত খেলিয়ে বিদুর  বার বার তৃপ্তির ব্যাঘাতে ব্যক্তিসত্ত্বা জাগিয়েছেন,  নিজেরই একার।।

বিদুরের শান্ত সৌম্য চেহারা এক লুকানো আকর্ষণ ; চকিত হৃদয় বিদীর্ণ করার তো কোনো অস্ত্র নেই, বিগলিত করুণার নির্ঝরই প্লাবিত দেহ মনের আকর্ষণ ; উন্মুখ আকাঙ্ক্ষার উষ্ণ প্রস্রবণ, যেন রোমকূপ স্নায়ুর মধ্যে আগুন ঢালে।এ এক অনন্য অনুভূতি ; শীতল নিথর দেহের উপর  ক্লান্তিকর বিষম দম বন্ধ করা একফালি আলো হাওয়ার প্রতীকী বিদুর ; হাওয়া মুক্তির শ্বাস তিনি,  চিত্রকরের আঁকা চিত্রপটের মূর্তি।

কুন্তীর একমূহুর্তে মনে হলো স্বপ্নগুলি যখন আলসের উপর বসা কপোত কপোতীর মতো ডানা ঝাপ্টা ঝাপ্টি, কিন্তু বলার জন্য ঠোঁট নাড়ে চড়ে, তা এক অনন্য অনুভূতি ; মনে হয় কাকে দিয়ে কখন যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়, তা মনে হয় সৃষ্টিকর্তায় জানেন না। মানুষের অজান্তেই ইতিহাস গড়ে ওঠে৷ চলকানো স্রোতে মতো  উন্মত্ত উৎসারে ধেয়ে চলে নিঃশব্দে। কুন্তীর জীবন দিয়েই এক ইতিহাস লিখে দেয়, তাকে ধাত্রীবোধ বললে অতুক্তি হবে না। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: