শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

মুঘল শাহাজাদী জাহানারা বেগম, জন্ম ২৩ মার্চ ১৬১৪ খৃষ্টাব্দ। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৬৮১ খৃষ্টাব্দে মৃত্যু। জাহানারা বেগম মমতাজ মহলের গর্ভে জন্ম নেয়। । আরেক কন্যা রওশন আরা। যার সাথে জাহনারার বিরোধ ছিলো। জাহানারা বেগম পিতা সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় কন্যা ছিলেন। কিশোরী জাহানারা ১৩/১৪ বছর বয়সে অগ্নি দগ্ধ হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হন। তার শরীরে আগুন লাগার দুইটি কাহিনী ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত সুগন্ধি তেল থেকে জাহানারার পোশাকে আগুন লেগে যায়৷ দ্বিতীয় কাহিনী, তার এক দাসীর গায়ে আগুন লাগে, যে নাচে সুনিপূণ  ছিলো। জাহানারা তাকে রক্ষা করতে গেলে নিজেও আগুনে পুড়ে যায়! প্রায় ১ বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হয়।

জাহানারার ১৭ বছর বয়সে তার মা মমতাজ মহল মারা যায়। তার মায়ের পদবী ছিলো "পাদশা বেগম" অর্থাদ বাদশা বেগম। যা মোঘল নারীর সর্বোচ্চ পদ। সম্রাট শাহজাহানের আরো দুই  স্ত্রী থাকার পরও কন্যাকেই এই সর্বোচ্চ পদ দেয়া হয়। মা মমতাজ মহল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে রেখে যায় যেন, জাহনারা তার পিতার দেখাশোনা করে।

১৬৫৭ সালে শাহজাহান অসুস্থ হয়ে গেলে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় চার পুত্রের মধ্যে। জাহানারা পিতার পছন্দের পুত্র, দারাশিকোর পক্ষ নেয়। তার আগে সমঝোতার প্রস্তাবও দেয় জাহানারা। যাতে ভাইদের মধ্যে সংঘাত না হয়। জাহানারার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে; আওরঙ্গজেব পিতাকে বন্দী করে। দারাশিকো যুদ্ধে পরাজিত হলে তাকে বন্দী ও হত্যা করা হয়। বোন, জাহানারা বেগমকেও  পিতা শাহজাহানের সাথে আগ্রা দূর্গে বন্দী থাকতে হয়। যতদিন শাহজাহানের মৃত্যু না হয়।
বন্দী পিতা সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যু হলে, আওরঙ্গজেব বড় বোন জাহানারা বেগমকে আগ্রা থেকে দিল্লীর রাজদরবারে ফিরতে বলে। কিন্তু জাহানারা জানায়, যেহেতু সে  আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ছিলো এবং বাবা শাহজাহান ও বড় ভাই দারাশিকোর পক্ষে৷ তাই তার কথা কেউ শুনবে না। তা ছাড়া তার ছোট বোন  রওশন আরা "পাদশা বেগম"  উপাধিতে রয়েছে  তাই সেও  বিরোধিতা করবে।  আওরঙ্গ,  জাহানারা বেগমকে নিশ্চয়তা দেন, তার কোন সমস্যা হবে না। প্রসাদের সকলেই তার কথায় চলবে,শুনবেও। কেন না, ছোট বোন রওশন আরার লোভী ও অহংকারী আচরণে প্রাসদের সকল নারীই ক্ষুব্ধ। অতপর আগ্রা থেকে দিল্লীতে চলে  আসেন জাহানারা। পাদশা বেগম উপাধী ফেরত পান। এবং আমৃত্যু আওরঙ্গজেবকে রাজকাজে সহযোগীতাও করেন।
জাহানারার ব্যবসা বানিজ্য ও ক্ষমতা দেখে বৃটিশরা বিস্ময় প্রকাশ করে। একজন নারী এত ক্ষমতাবান হতে পারে তা তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারতো না। কেন না, তখন বৃটিশ রমনীরা এত স্বাধীনতা ভোগ করার কথা ভাবতেই পারেনি।
ইউরোপীয় এক লেখক তো,  লিখেছেন, জাহানারার সাথে পিতা শাহজাহানের যৌন সম্পর্ক ছিলো। তা না হলে এত ক্ষমতা সম্পদ  কি করে পায়! অবশ্য এসব কথা আরেক ইউরোপীয় লেখক বাজারে চলা গুজব বলে উড়িয়ে দেন।

জাহানারা বেগমের  নিজস্ব ব্যবসা ছিলো। তার বানিজ্য জাহাজ ইংরেজদের মত দেশে বিদেশে ঘুড়ে বেড়াতো। মা মমতাজ মহলের গচ্ছিত অঢেল সম্পত্তির মালিকানাও পেয়েছিলো জাহানারা। এ ছাড়া ভাতা পেতো। জায়গিরদারীও ছিলো; খাজনার অংশও পেতো। ক্ষমতার প্রভাব তো ছিলোই। এসব তখন অন্যদেশের কোন নারী কল্পনাও করতে পারতো না।

জাহানারা শিক্ষানুরাগী  ও দানবীর ছিলেন। তার যেমন সম্পদ ছিলো তেমনি দান করতেন প্রচুর। এমন কি তার দান ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে তার বানিজ্য জাহাজ যখন প্রথম বিদেশে যাত্রা করে, তখন নির্দেশ ছিলো, সে জাহাজের দায়িত্ব প্রাপ্তরা যেন মক্কা মদীনার দরিদ্রদের ৫০ কোনি চাল (৫০ কোনি সমান চার মণ) সাহায্য দিয়ে আসে। এবং তা প্রতিবছরই দিতেন। জাহানারা বেগম,  নুরজাহানের মত বেশ কিছু বানিজ্য জাহাজের মালিক ছিলেন। যা ইংরেজ ও ডাচদের সাথে বানিজ্য করতো। ভারতবর্ষ তখন পৃথিবীর একচতুর্থাংশ অর্থসম্পদের অধিকারী। যার মালিক ছিলো, মুঘল পরিবার।

জাহানারা বেগম ৬৭ বছর বয়সে মারা যায়। অবিবাহিতা ছিলেন তিনি। তবে তার মৃত্যুর আগেই দিল্লীতে নিজামউদ্দীনের মাজারের পাশে কবর দিতে অসিয়ত করে যায়। সে অনুযায়ী তাকে দিল্লীতে নিজামুদ্দিনেই কবর দেয়া হয়। মুঘল রমনীদের মধ্যে তার কবরটাই সাদামাটা। এটাই নাকি জাহনারা বেগমের নির্দেশ ছিলো

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: