প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

পৃথা, এক নবীন বালিকা কিশোরী। নতুন জীবনের দায়িত্ব নিয়েছে অস্বাদ ভোগের সামগ্রী।হারিয়ে গেছে আদর, আসলে গর্ভগৃহ যে আজ অন্তর সন্ন্যাস, ভুলতে পারেন কি, পৃথা!! বাসনার পৃথার আজ মৃত্যু হয়েছে। গোত্রান্তর, দুঃখ, ভয়, অধিকারের বোধ যেন স্বার্থ ডেকে আনে৷ বুকের গহনে রক্তক্ষরণ বয়ে যায় রোজ। এখানে বড্ড মনে পড়ে সারদামায়ের কথা, "সন্তোষের সমান ধন নেই, আর সহ্যের সমান গুণ নেই। " কিন্তু বুকের ভিতরে যে টাটকা ঘায়ের গন্ধ, একে কি প্রবৃত্তি বলবো!  জন্মনাশের হেতুতেই প্রবৃত্তির নিবৃত্তি। মনকে সান্ত্বনা দেয় যে, মিথ্যা জ্ঞানের উচ্ছেদ সাধন না করতে পারলে দুঃখের হাত হতে নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই।রাজমাতা তাঁর জীবনে জয়ের গর্ব। চার দ্বীপের বাসিন্দার তাঁরা৷ নির্জন বনে বৌ কথা কও, চোখ গেলো পাখি ডাকে, নদীর ঝর্ণা প্রাবাহের আহ্লাদ যেন প্রকৃতির সত্ত্বগুণ। বাঁদরের হুপ হুপ তো মানুষের ভাষাসঙ্গী নয়। আর জীবাত্মার বাহ্যেন্দ্রিয় বা জ্ঞানেন্দ্রিয় যে আশ্রয় সবটুকু ছুঁয়েই তো মন। অব্যয় আত্মার বিনাশ নেই, কিন্তু সমগ্র শরীর পরিব্যাপ্ত করেও জীর্ণ দেহ তাঁকে বলে, "তুমি একলা, তুমি একলা। "
কুন্তীতে পরিণত না হলে হয়তো জীবনটা অন্য হতো৷ হয়তো কুন্তীও শুনতেন,
"দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদযুগপদুত্থিতা ।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।।
না এমন এক দীপ্ত প্রকাশের মহাত্মা তেজ তো নেই তাঁর জীবনে৷ অদৃষ্টের জীবনে ফাঁকি দিয়েই তো জীবনটা যেন ভিন্ন স্রোত খুঁজে নিলো। আসলে স্নেহ, ভালোবাসা পরিপূর্ণ গৌরব তো যাপনের সহচর, তবুও দুই যমজে একজন প্রাণ দেয়, অন্যজন হরণ করে নেয়। উত্তীর্ণের অনুকরণ তো প্রবৃত্তি, তাই স্বতন্ত্র বন্ধন এলে সর্বনাশ উপস্থিত হয়। কুন্তীর জীবন কখনও তরঙ্গবলয়ের আবর্ত থেকে মুক্তি পায় নি। অভিব্যক্তির খোঁজ, তবু মনে পড়ে দুর্বাসার সেই আয়োজনের চোখ । সবাই দুধ দিয়ে আতিথ্য করছেন তাঁকে। দূঢ়তাকে তিনি ছুঁয়ে গেছেন বহু পূর্বে। সর্বাগ্রে চাই মানুষের গঠন। আচ্ছা!  দুর্বাসার প্র‍তি কুন্তীভোজের এতো সমাদর কিসের? চিন্তাই তো মামুষকে সুস্থ পথ দিতে পারে। সুস্থ চিন্তা তো মোহ আনে না৷ তবে এই নশ্বর দেহে এমন স্পর্শকাতর পুরুষের জন্য এতো সমাদর! কি দিতে পারেন তিনি!!  " শাপ " ; কোনটা অপরাধ কুন্তীভোজের!  অশান্তি, বিশৃঙ্খলার এই আপদ কু চিন্তা তো মুক্তি পেতেই কি এতো বোধের আলোড়ন!
মনে পড়ে যাচ্ছে, কনফুসিয়াসের অমৃতবাণী। কিন্তু তিনি বলেছিলেন," আমি বিশ্বাস করি মানুষের বুকের মধ্যে ঈশ্বরের বসবাস।  মানুষের শরীর হলো স্বর্গ। " তন্ত্র মতে, শরীর হলো ব্রহ্মান্ড। আর চন্দ্র নাড়ি হলো ইড়া, সূর্য হলো পিঙ্গলা! তাহলে কেন, কেন এই আপ্যায়নে মাদকতা!!

দুর্বাসা মগধ সম্রাটের জরাসন্ধের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। জরাসন্ধ খুব বাধ্য তার। দুর্বাসার তত্ত্বাবধানেই তো তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের গতিবিধি নজর রাখার একটি কার্যকরী  সংস্থা গড়ে উঠেছিল। আসলে তাঁর আগমন হলো দ্বন্দ্ব নিষ্কৃতির ফসল। ইতিহাস মনে পড়ে যায়, " প্রেম রজ্জুর স্বরূপ। প্রেম হলে ভক্তের কাছে ঈশ্বর বাঁধা পড়েন৷  আর পালাতে পারে না। " এই আয়োজনও তাই, তৃপ্তির পটে নিরাপদ আশ্রয়। প্রতিবাদ অন্তরে রেখে কৌশলে ঋষির উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার পর দায়িত্ব অর্পিত হলো কুন্তীর উপর৷ এ যেন " ডকটিন অভ ল্যাপস "এর প্রভাব  পড়ছি। গঙ্গাধর রাওয়ের ইচ্ছা এবং প্রিয় মানু র ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়েও রাজা আবার বিবাহ করেছিলেন৷ তাঁর স্ত্রী ঝাঁসির উপর তাঁর রক্ষার দায়ভার পড়ে যায়৷ এমনই দায়ভার যেন নবীন থেকে কুন্তীকে রমণীতে পরিণত করে৷ এতো কৌশলগত প্রত্যয়৷ ভোজ রাজ যে জ্ঞানী, বিচক্ষণ। মায়াতেই তো বন্ধন। তবু কর্তব্য যে নাড়ীর পিঞ্জরে বাঁধা। হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু এটাই শাশ্বত, ন্যস্ত নিয়মের সীমাবদ্ধ নাম, " নারী "। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: