দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী, প্রবাসী লেখক, টরোন্টো, কানাডা:

বিলেত থেকে কেউ এলেই একসময় পাড়ায় কলরব হতো। আমার মনে আছে এক লন্ডনের ভদ্রলোক আমার দিদিকে দেখতে আসেন। গায়ে টেরিলিনের শার্ট, লাল টাই, কেষ্ট মুখার্জীর মতো চেহারা। আরিব্বাস সেকি প্রশ্ন? আমার দিদিও একজন দারুন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহিলা। কয়েকটা কথার পর সাহেব তার নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রমান দেখতে গিয়ে হিমশিম। বহু বছর পরে আমি তখন লন্ডনে; সেই সাহেবের সাথে দেখা।কাউন্টি অফিসের কেরানি। এরকম মিথ্যায় বলে বহু বিয়ে হয়েছে আগে কিন্তু এখন আর হয় না। আজকাল সব পরিবারের কেউ না কেউ বাইরে থেকে। টাই পরে কলকাতায় ঢপ মারা লোক এখন বিদেশ থেকে আসে না। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন অভিবাসীদের দেশ।ব্রিটেনে জার্মানিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পুরুষ মানুষের খুব অভাব হয়ে পড়েছিল। কাজের লোক ছিল না।ষাটের দশকে বহু ছেলে রাজ্য থেকে জার্মানিতে চলে যায়। তখন ভিসা লাগতো না। এইসব ছেলেরা সেখানে গিয়ে নতুন করে ভাষা শিখে, কাজ শিখে থেকে যায়।জার্মানি কিন্তু কোনোদিন এদের নাগরিত্ব দেয়নি। কাজ করো, থাকো খাও। অনেকে বিয়েও করেছিল। ব্রিটেনে বহু মানুষ গিয়েছিলো। ব্রিটেন যাওয়া মানুষরা আবার একটু বেশি শিক্ষিত জার্মান যাওয়া মানুষদের থেকে। জার্মানিতে যাওয়া মানুষেরা ছিল হাতের কাজ জানা মানুষ বা ওখানে গিয়ে ওয়েল্ডার, টুল ডাই মেকার, ড্রাফটসম্যান , ইলেক্ট্রিশিয়ান বনেছিলো। খুব ভালো আয়। ব্রিটেনে যাওয়া বাঙালিরা কেরানি, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ছিল। পরে ব্রিটেন আর লোক নিতো না কারণ ছোট্ট একটা দেশে অভিবাসীরা প্রায় দখল করে নিয়েছে। প্রতিশোধ। তোমরা বিশ্বের প্রায় সব দেশে কি ছড়ি ঘুরিয়ে শাসন করেছো, লুঠ করেছো। এখন আফ্রিকা, ভারত, ক্যারিবিয়ানের মানুষেরা তাদের রানীর দেশে তো আসবেই। আমেরিকা কানাডার উপায় নেই লোক নেওয়া ছাড়া। ওদের লোক সংখ্যা কম। প্রতি বছর এই দুই দেশ দুশো তিনশো হাজার মানুষ সারা বিশ্ব থেকে নিয়ে থাকে। সব রকমের লোক ওদের দরকার।আমেরিকাতে আপনি একবার ভিসা পেলে আপনার সব রক্তের সম্বন্ধ আত্মীয়দের আনতে পারবেন। কানাডা শুধু বাবা মা আর তাদের আঠারো বছরের কম ছেলে মেয়েদের আনতে দেয়। ভারতীয়তে ভরে গেছে আমেরিকা কানাডা। আর একবার যদি ঢুকতে পারেন তবে আপনার লটারির কোটি টাকা পাওয়ার মতো ব্যাপার। আবার বহু কুয়োর ব্যাঙ বাঙালির ধারণা যে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, আর নিচু কাজ করে থাকি। তা বটে, আমি মনে মনে বলি। তুমি হরিদাস দেশে কোন শ্রেণীর নাগরিক? তোমার বাবা পেনশন পান না, তোমার কব্জি কাটা হয়, মেরে পুঁতে দেওয়া হয় আর মন্ত্রী চোদ্দ বছর হারামে খায় অবসর গ্রহণের পরেও? এখানে আমরা বহু আমেরিকান কানাডিয়ানদের কাজ দিয়ে থাকি আমাদের কোম্পানিতে। বহু কোম্পানির কর্ত্তা ভারতীয়রা। রোজ লক্ষ লক্ষ ভারতীয়রা কানাডা আমেরিকা দূতাবাসে হত্যে দিয়ে পরে আছে ভিসা পাওয়ার জন্য। কি করে আসবেন এদেশে? পরের সংখ্যায় জানাবো। টরোন্টো শহরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আছে প্রায় কুড়ি হাজার। বাংলাদেশি তিরিশ হাজার তো হবেই।
আমরা পুরানো পাপী। এসেছি সত্তর সালের মাঝামাঝি। অনেকে ষাটের দশকে। বহু বাঙালি জার্মানি থেকে চলে আসে কানাডাতে। কানাডা নতুন দেশ। জনসংখ্যা কম। দেখেছি একজন কলকাতার শ্রমিক নিজ চেষ্টায় এদেশে এসেছে সেই হাওড়া থেকে। কাজ করতেন কোনো কারখানায় দক্ষ শ্রমিক হিসাবে। ওয়েল্ডার বা ইলেক্ট্রিশিয়ান। যেদিন উনি টরোন্টোতে নামলেন সেদিন থেকে তার চাকরি খোঁজা শুরু হলো। সরকার সব রকমের সাহায্য করে থাকে এই নতুন আসা মানুষদের।ভদ্রলোক কাজ পেলেন এক কারখানায়। একটা ছোট ফ্লাট নিলেন। সেই থেকে শুরু হলো তার প্রায় স্বপ্নের  জীবন। ফ্লাট মানেই সোফা সেট, ফ্রিজ, গরম জল দিবা রাত্রি, স্টোভ ইলেক্ট্রিকের। আর ফ্রিজ ভর্তি ফল, মাংস, দুধ, মাখন, যা খুশি উনি খেতে চান। সব নাগালের মধ্যে। শুধু কাজে যেতে হবে সময় মতো। কাজ করতে হবে মন দিয়ে। সিপিএমের ইউনিয়ন বা মালিকের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেবার শব্দ মুখ থেকে বেরুতে পারবে না। দেরি করে কাজে গেলে কোনো শুক্রবারে হাতে পিঙ্ক চিট ধরিয়ে দেবে। আর সব পাওনা গন্ডা। কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। কাজেই এদেশে পা দেবার সাথে সাথে শয়তান নেতা বিড়াল বনে যায়। কার কাছে যাবে? ইউনিয়ন টাকা খায় না, দলবাজি করে না, শুধু শ্রমিকের সুবিধা দেখে। দেরি করে গেলে বা কাজে গাফিলতির জন্য ইউনিয়ন মাথা গলায় না। পুলিশ সরকারি দলদাস না। মন্ত্রীকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় ঢোকায় দরকার হলে। কাজেই আমরা সত্যি খুব আইন মেনে চলি। নইলে পিটিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেবে। আর দেশে ফেরত যাওয়া? দুঃখ নেই এদেশে? আছে আছে । বলবো সে সব কথা। (ক্রমশঃ)

(ছবি প্রাপ্তি: প্রতিবেদক। ছবিতে প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রতিবেদক ও অন্যান্যরা।)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: