রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আয়না বা দর্পণ বা আরশি এগুলির অর্থ একই যে, এমন একটি বস্তু যাতে অন্য কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব বা কায়া দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাষায় বস্তুটির বিভিন্নরকম নামকরন হয়েছে। আয়না এমনই একটা বস্তু যাতে মানুষ তার সুন্দর/কুৎসিত চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় এবং নিজের চেহারা, মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করে নারী-পুরুষ উভয়েই। এই আয়নার ব্যবহার /প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। তবে সৃষ্টির আদি পর্বে যখন আয়নার ব্যবহার সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল না তখন একে অন্যকে দিয়ে নিজের সৌন্দর্য দেখানোর চেষ্টা করত। মানুষ আয়নায় তার চেহারার প্রতিচ্ছবির চাইতে যেটা বেশী করে দেখে তা হল তার মুখের সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।
             মুখ হল মানুষের শরীরের এমন একটা স্থান যার সাহায্যে একে অন্যের সাথে মৌখিক পরিচিতি ঘটাতে পারে। প্রকৃতির এমন সৃষ্টি যে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের বসবাস কিন্তু একজনের সঙ্গে অন্যজনের চেহারায়, মুখে কোনো মিল নেই সাধারণ পর্যায়ে। মুখের গঠনই মানুষের চারিত্রিক পরিচয় দেয়। কোনো মানুষের দোষ-গুণ, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সবই মুখের অবয়বে প্রকাশ পায়।
                মন হল মানুষের চরমভাবাপন্ন স্থান যাকে বাংলায় 'হৃদয়', হিন্দীতে 'দিল' এবং ইংরাজীতে 'হার্ট' বলা হয়। মানুষের জীবন সম্পূর্ণভাবে এর উপর নির্ভরশীল। মন হল লজ্জাবতী পাতা। লজ্জাবতী পাতাকে স্পর্শ করলে নুয়ে পড়ে আবার কিছুক্ষণ পর তা পূর্বাবস্তায় ফিরে আসে। মন ও তেমনই একটি বস্তু। মনে কোনো আঘাত /আচঁড় লাগলে মানুষ বিমর্ষ বোধ করে। সেই আঘাত যদি জোড়াল হয় তবে কখনো কখনো তা সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে যায় এবং এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। মনের চারিত্রিক বহিঃপ্রকাশ মুখের মাধ্যম হয় থাকে। মানুষের জীবনের প্রতিদিন প্রতিটি মূহুর্ত একরকম যায় না। সেই মূহুর্তগুলো কখনও ভালো কখনও বা মন্দ, তার প্রতিচ্ছবি মুখের চেহারায় প্রকাশ পায়, কোনো মানুষ সুখে আছে না দুঃখে আছে তাও মুখ দেখেই বোঝা যায়।
              কোনো মানুষ মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থায় আছে কিন্তু বাহ্যিক দিক থেকে সকলের সামনে ফিটফাট হয়ে থাকার চেষ্টা যতই করুক না কেন দেখা যাবে তার মুখের চেহারায় অভ্যন্তরীন সমস্ত বিষয় ফুটে উঠেছে।  একজন সৎ মানুষ ও একজন অসৎ মানুষকে যদি পাশাপাশি রাখা হয় তবে এক পলকেই তাদের মুখ বলে দেখে বলে দেওয়া যাবে যে কে সৎ এবং কে অসৎ। অর্থাৎ মুখই মানুষের সব। অনেকেরই ধারনা আছে যাদের অর্থ আছে বা বড়লোক /উচ্চবিত্ত/ধনী তাদের ঘরে রূপের বাসা যেমন আছে তেমনি সুখ ও শান্তির বাসা, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধারনা ভুল। অর্থ থাকলেই সুখ-শান্তি থাকে না, সুখ যদিও বা শান্তি তো নয়ই। তাদের ঘরে সবাই ব্যস্ত বিভিন্ন জায়গায়, একজনের সঙ্গে বাড়ীর অন্যজনের যোগাযোগ কম, ছোটো থেকে সন্তানরা বাইরের লোকের কাছে বড় হয়। সন্তানরা বাবা -মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় আবার মা- বাবাও সন্তানদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা -ভক্ত-মর্যাদা কম পায়। ফলে তাদের সন্তানেরা ভালোবাসার পিয়াসী হয় এবং শেষ পর্যন্ত মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয় পড়ে।
          অর্থাৎ আয়নায় যেমন প্রতিচ্ছবি /কায়া ফুটে ওঠে তেমনই মনের সমস্ত বিষয়গুলি মুখের মাধ্যমে ফুটে এবং তা সকলের সামনে প্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং একে অপরের উপর নির্ভরশীল বা সম্পূরক। মুখ যেমন মনের উপর নির্ভরশীল আবার আয়না মুখের উপর নির্ভরশীল কারণ আয়নায় মুখের প্রতিচ্ছবি আর মুখে মনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তাই বলা যায় মনের প্রতিচ্ছবি আয়নায় দেখা যায়। অর্থাৎ 'মুখই মনের আয়না'।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: