কাজী জহিরুল ইসলাম, রাষ্ট্রপুঞ্জে কর্মরত ও লেখক, নিউইয়র্ক, আমেরিকা:

যেসব দেশে দারিদ্রসীমার নিচে অধিক মানুষ বাস করে সেসব দেশের জন্য বিপদ এখন দ্বিমুখী। লকডাউনে গেলে দূর্ভিক্ষ, না গেলে মহামারী। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সম্ভবত কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকবে। ২০১৬ সালের সরকারী হিসেবে তা ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের প্রকৃত চিত্র সরকারী হিসেবের সাথে কতটা মেলে তা যার যার মত করে আন্দাজ করে নেবেন। আমাদের তো আন্দাজ করেই চলতে হয়। সকল সময়েই সরকার, প্রশাসন, পেশাজীবী সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনকে সত্যের সাথে বিরোধিতা বা শত্রুতা করতেই দেখি। সত্যের যে কি অপরাধ তা আজও বুঝলাম না। কি সরকারী দল কি বিরোধীদল, সকলেরই শত্রু হচ্ছে সত্য। কে কতো সুন্দর করে, চাতুর্যের সাথে মিথ্যা বলতে পারেন, এটিই তার যোগ্যতা। মিডিয়াই ছিল জনগনের একমাত্র ভরসা, সেই মিডিয়াও এখন নানান দলের, মতের, লোকের আজ্ঞাবহ হয়ে যাওয়ায় কোথাও আর সত্য নেই। সত্য এখন সেই ফরাসী উপকথার মত নির্বাসিত। গল্পটি বলেই ফেলি।

সত্য এবং মিথ্যা দুই রূপবতী যুবতী। দুই বোন। ওরা হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখে একটি কুয়ো। মিথ্যা বলে, চল কুয়োর স্বচ্ছ জলে স্নান করি। ওরা দুজন নিজেদের পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে কুয়োর ভেতরে সাঁতার কাটতে লাগল। সত্য ডুব সাঁতার কেটে কুয়োর তলদেশ দেখতে গেল। মিথ্যা ওপরে উঠে সত্যের পোশাক পরে চলে গেল লোকালয়ে। যখন সত্য ভেসে ওঠল চোখ মেলে দেখে মিথ্যা নেই। সত্য কুয়ো থেকে উঠে আসে। দেখে ওর পোশাক নেই, মিথ্যার পোশাক পড়ে আছে। সত্য নগ্ন হয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকালয়ে চলে যায়। লোকেরা নগ্ন সত্যের পরিচয় জানতে চাইলে, সত্য নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, আমি সত্য। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই বলে একটু আগেই তো আমরা সত্যকে দেখলাম। তুমি সত্য নও, অন্য কেউ।

বাংলাদেশের অবস্থা এখন এরকম। সত্যের পোশাক পরে মিথ্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তো প্রশাসনের দেয়া মিথ্যে তথ্য থেকেই আমরা একটা কিছু আন্দাজ করে নিই। প্রকৃত সত্য আমরা কোনোদিনও জানতে পারি না। বাংলাদেশে কতজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, কতজন মারা গেছে এসবের কিছুই আমরা জানতে পারি না। এসব না জানতে পারলেও বিশ্বের নানান দেশের তথ্য থেকেই আমরা আন্দাজ করে নিয়েছি বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা অনেক, মৃতের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। সবচেয়ে ভয়ের কথা যা তা হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের সামনে যে ভয়াবহ একটি সময় অপেক্ষা করছে তা আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারছি। এ থেকে বাঁচার উপায় কি? সেটাও কিন্তু আমরা বুঝতে পেরেছি।
বাঁচতে হলে আমাদেরকে পুরোপুরি লকডাউনে যেতে হবে। লকডাউনে গেলে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে বটে কিন্তু গতরখাটা মানুষগুলো খাবে কি? তাদের হাতে কি উদ্বৃত্ত টাকা আছে না খাদ্য মজুত আছে? বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের পরিবার এখনো দিনের শেষে যা আয় হয় তা দিয়ে পরের দিনের চাল, ডাল কেনে। এই মানুষগুলো কতদিন লকডাউনে না খেয়ে থাকবে? দুই দিন, তিন দিন৷ তারপর? ওদেরকে তো দোকানীরা বাকিতে সওদাও দেবে না। ওদেরকে কি লকডাউনে আদৌ আটকে রাখা যাবে? ধরা যাক দুমাস লকডাউনে থাকতে হবে। এই দুই মাস কোটি কোটি পরিবার কর্মহীন, উপার্জনহীন হয়ে পড়লে তারা কি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়বে না অর্থ, খাবার সংগ্রহের জন্য? সারা দেশে এক সম্ভাব্য অরাজক পরিস্থিতি কি কোনো অলীক চিন্তা? সমূহ দুর্ভিক্ষের একটি চিত্র কি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে না? লক ডাউনের কারণে পণ্য পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। কোথাও কোথাও উৎপাদিত পচনশীল খাবার পরিবহন ও বাজারজাত সঙ্কটের কারণে পচতে শুরু করবে। আবার কোথাও কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে দ্রব্যমূল্য অত্যাধিক বেড়ে যাবে। খাদ্যসামগ্রীর প্রতুলতা নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনের মতো সরবরাহও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই সূত্র প্রমাণ করেই অমর্ত্যসেন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

এবার অন্য দৃশ্যটি দেখি। মানুষ লকডাউন যথাযথভাবে মানল না। গতরখাটা মানুষেরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তখন কি হবে? তারা করোনা ভাইরাসের কবলে পড়বে। ঘরে নিয়ে আসবে। ঘরের সকলের হবে। তারা যাদেরকে সেবা দেবে তাদের হবে, তাদের পরিবারের হবে। এভাবে মহামারী আকার ধারণ করবে। বাঙালিরা যে নিয়ম মানে না তা তো আমরা নিজেরাই ভালো করে জানি। গতকাল পরিস্থিতি বোঝার জন্য গাড়ি নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্কের অনেক বাঙালি, ভারতীয়, পাকিস্তানি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু এখনো খোলা আছে। একটি বড় গ্রোসারি শপের নাম প্রিমিয়াম। গতকাল (৬ এপ্রিল) জ্যামাইকার প্রিমিয়াম গ্রোসারিতে দেখি প্রচুর লোক। সবচেয়ে ভয়ের যেটি, ক্যাশ কাউন্টারগুলোর সামনে মূল্য পরিশোধের বিশাল লাইনে সবাই দাঁড়িয়েছে গায়ে গায়ে লেগে। সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে ৬ ফুট দুরত্বে দাঁড়াবার কিন্তু কেউ ৬ ইঞ্চি দূরেও দাঁড়াচ্ছে না। কেন দাঁড়াচ্ছে না, কারণ একটু দূরে দাঁড়ালেই ফাঁক দিয়ে অন্য একজন ঢুকে পড়ছে। দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করে বসে বসে এই দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখলাম।

ফিরে আসি বাংলাদেশে। এখন আমাদের করনীয় কি? আমাদের অবশ্যই লকডাউনে যেতে হবে এবং তা কঠোরভাবে মানতে হবে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। দুইবেলা খেতে হবে। সম্ভব হলে একবেলা ভালোমত আর একবেলা নাস্তার মতো হালকা খাবার খেতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ সারা জীবনই দুইবেলা খায়। আমি সুদানে ছিলাম দেড় বছর। সুদানের মানুষেরা, ধনী, গরীব সকলেই, সারা বছর, দুইবেলা খায়। এই লক ডাউনের সময়ে আমার পরিবারেও দুইবেলা খাওয়ার অভ্যাস চালু করেছি। যাদের প্রচুর আছে তাদেরও এই কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে। ধনীদের উদ্বৃত্ত দিয়ে দরিদ্রদের এই দুঃসময়ে সাহায্য করতে হবে। সরকার যেসব প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেগুলোর স্বচ্ছ বাস্তবায়ন পরিকল্পণা থাকতে হবে। যেমন নিউ ইয়র্কের সব বাড়িওয়ালাকে আগামী তিনমাস বাড়ির ঋণের কিস্তি দিতে হবে না। এর সুবিধাটা কে পাবে? বাড়ির মালিক? মোটেও না। সাথে সাথে এটাও ঘোষণা করা হয়েছে আগামী তিন মাস ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ভাড়া দেবে না। ঠিক এভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে যাতে সুবিধা পৌঁছায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। গার্মেন্টস মালিকদের কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ দেবার সাথে সাথে এটাও নিশ্চিত করতে হবে আগামী তিন মাস যেন প্রত্যেক মালিক প্রতিটি শ্রমিকের বেতন যথাসময়ে পরিশোধ করে। লকডাউনের অজুহাতে যেন কারো বেতন বন্ধ না হয়। যারা দিন মজুর তাদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা থাকতে হবে এবং তা মনিটর করার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে একটি টোটাল প্যাকেজ তৈরি করতে হবে, প্রতিটি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্স তৈরি করতে হবে এবং কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচক্ষণতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারলে হয় মহামারি না হয় দুর্ভিক্ষ, এ থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধটা এবার জাত-পাত নিরপেক্ষ এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: