প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

অন্তিমে মহাকালের খেরোর খাতায় নিভে গেছে দেউটি। অর্জুন হত্যা করেছেন জয়দ্রথ  কর্ণ,  কর্ণপুত্র বৃষসেনকে;   সহদেবের হাতে মারা পড়েছেন সপুত্র শকুনি, অর্থাৎ শকুনি ও তস্যপুত্র উলূক। ধৃষ্টদ্যুম্ন হত্যা করেছেন দ্রোণ ও শাল্বকে ; কর্ণ বধের পরে কৌরবসেনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শল্য ; কর্ণ হলেন অবস্থায়  নিহত দলিল৷ কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যে অংশটি অপরিষ্কার, কাদা কাদা, সেখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন কর্ণের রথ। কর্ণ ভীমের ছেলে হিড়িম্বার গর্ভজাত ঘটোৎকচকে বধ করেছিলেন৷ প্রতিহিংসার অনলে দ্রোণ পুড়েছিলেন, যা নিভিয়েছিলেন দ্রুপদ ও বিরাটকে হত্যা করে৷ বিরাট কন্যা উত্তরাকে বিধবা করার ক্ষেত্রেও দ্রোণের ভূমিকা অপরিসীম।  কর্ণ, জয়দ্রথ, অশ্বত্থামার সঙ্গে একযোগে অভিমন্যুকে  নিধন করলো। পূর্বে দূর্যোধন মায়ের কাছে  আশীর্বাদ চাইতে গেছিলেন ; মা বলেছিলেন, যেখানে ধর্ম, সেখানে জয়।  তবে কি আত্মশ্লাঘা অগ্নিব্যূহ্যের পূর্বাভাস সেদিনই হয়েছিল, কারণ ধর্ম মানে বিদুর, শ্রীকৃষ্ণ কেউ তাঁর পক্ষে নেই ; আছেন এখনও কম্বোজসেনা, অন্ধক সেনা, আর দশ হাজার সংশপ্তক।  তারা তো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

"উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমালয়স্ট দক্ষিণম..;   বর্ষং তদ ভারত যত্র সন্ততিঃ, " সেই ভূমির কথা। " যদি দং ভারতং বর্ষং যত্রেদং, মূর্ছিতং বলম ; "... এভাবে আত্মবীক্ষণে প্রণত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্র আত্মকথা ; এক অজানা উপলব্ধির তাড়নায় দুর্যোধনকে ঘিরেই তো অন্তিম স্বপ্নপ্রহর৷ এ যেন, শেষ আশার সলতে জ্বলেছিল ধৃতরাষ্ট্রের মনে। দূর্যোধনকে হাড়ে চিনেছিল ভীমসেন। " ম্রিয়েতাপি ন ভজ্যতে নৈব জহ্যাৎ স্বকং মতম "; শবের স্তুপের উপর দিয়ে হাঁটা পথে একাকী নগ্নপদে অক্ষৌহিণীর অধিপতি৷ দ্বৈপায়ন হ্রদের জল অতি পবিত্র, শক্তিবর্ধক, ইষ্টকারী। রমনীয় চোখে বিমোহন, পুরুষের চোখে ঈর্ষণীয়, শুধু ক্ষতচিহ্নের অলংকার; প্রদীপ্ত সূর্যের মতো প্রতপন রশ্মি,  উন্নতশিখরে পর্বতের মতো, সশৃঙ্গমিব পর্বতম, শূলপাণি  রুদ্রের মতো, শূলহস্তং যথা হরম..  হ্যাঁ, দাঁড়িয়েছেন দূর্যোধন।
কিন্তু আজ তো পরাজয় নিশ্চিত। ভুল করে যুধিষ্ঠিরকে রাজা বললেন। তর্ক, কটুবাক্য, দম্ভোক্তি তখনও৷ বিশ্বের ইতিহাস বলছে, দ্বাদশ শতকে লেখা হয়েছিল  জার্মান মহাকাব্য " নীবেলূঙ্গেনলীড"।মনে পড়ে যাচ্ছে তৃতীয় সহস্রাব্দে রচিত সুমরীয় গিলগামেশ। দুটিতেই সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে ভূয়োদর্শিতা প্রতিফলিত। এমন করেই তো দান্তের দিহ্বিনা কম্মেদিয়া আর ইনফার্নো তে সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ উপলব্ধির সার্থক রূপায়ণ দেখিয়েছে। দূর্যোধন বহুমাত্রিক তাই বিশ্লেষণের ভাষায় রামধনু দেখা যায় না৷

যজ্ঞের আগুনে যিনি উদ্ভূত সেই দ্রৌপদীও
তো বিপ্লবের নিত্য বহ্নিমান শিখা৷ পুত্রহত্যা তাঁকে কদলীবৃক্ষের মতো সংজ্ঞাহীন করেছে৷ এবার তিনি শুষ্কশীর্ণা৷ তার শাপ আজ পাকবলয়ে ধ্বংস এঁকেছে৷ আজ গান্ধারী অগ্নিময়ী দ্রৌপদীও প্রাপ্তির ক্ষতির ঘর৷ অপ্রাপ্তির ঘর পূর্ণ করে সে আজ শোকার্ত। সময়ের বলে ঋতু পরিবর্তনের মতো করে দ্রৌপদী ক্ষুরধার জ্বিহা সঁপে এলেন।  সন্ন্যাসকামীর কাছে জাগ্রত করলেন দ্বৈতবনের স্মৃতি৷ তিনি কৃষ্ণের পরিপূরক৷। অর্জুনের হৃদয়ে সেদিন বোধের ঢেউ তো বাক্যের কশাঘাতে যুদ্ধমতি হয়েছিল৷ ভুললে চলবে না যে, সচেতনতার রূঢ়ভাষী স্বরূপে দ্রৌপদী স্পষ্টবাক৷ আসলে ভারতবর্ষের বুকে তাকে গঠন করতে এমন নারীশক্তিরই প্রতিযোগিতাকে সমমর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি। সময়াতনে তাঁর চাহিদা বদলে গেছে৷ তিনি যে ক্ষাত্রধর্মের আকর। তারপরই নারীর নয়া নির্দেশিকা জাগ্রত হয়েছে৷ একটু ইতিহাস দেখলেই বোঝা যাবে যে, নর্ডিক আর্যদের গরনেই যথার্থতাই কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণা৷ কৃষ্ণ তো যা চেয়েছেন তা অভীষ্ট প্রাপ্তি, কিন্তু কৃষ্ণার তো স্পষ্ট করে চাইতে হয়েছে। এটা ব্যক্তিগত এবং যুদ্ধের ধারাপাতবাহী।

তবে এখানে কৃষ্ণ অনেকটাই উত্তরকালের নেপোলিয়ান৷ যিনি কৃষ্ণের মতোই রাজমুকুটকে নিজের তরবারি দিয়ে মাটি থেকে তুলে  নিয়েছিলেন৷ তবে ১৭৯৯ সাল আর মহাভারতের যুগ তো এক নয়৷ সেখানে বিপ্রতীপ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়৷ সাময়িক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় অশ্বমেধের যজ্ঞের অছিলায়৷ তবে লক্ষ্য একটা "বহুজন হিতায়  বহুজন সুখায়  "। দ্রৌপদী ও কৃষ্ণ মানুষ। ঐশী সামর্থ্য অবলম্বনে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর চাওয়া মেটাতে আসেন নি। তাঁর আগুনেই তো পুড়েছিল রাজসূয় যজ্ঞ৷ সম্পর্কের বিচিত্র রসায়ন বহুমুখীকরণ বক্তব্যের যৌক্তিকতা ভরে কোল আঁকড়ে নিতেই পারে,  তবু স্বীকার করতেই হয়, দ্রৌপদী অভিষ্ঠের লক্ষ্যপূরণের যন্ত্রী। (সমাপ্ত)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: