শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

আশির দশকে পেরুর ৩৬ বছর বয়স্ক প্রেসিডেন্ট গার্সীয়া বলেছিলেন, মার্কিনীরা অভিযোগ করে দক্ষিণ আমেরিকা মাদক উৎপাদন ও পাচার করে থাকে। কিন্তু তারা এটা বলে না, যে, এই মাদকের খরিদ্দার মার্কিনীরাই। পেরুর সেই  কনিষ্ঠ বয়সী প্রেসিডেন্ট গার্সিয়া এ কথা চুপি চুপি বলেননি। বলেছিলেন, জাতিসংঘের অধিবেশনেই।

 ধনকুবের রকফেলার  নিউইয়র্কে কয়েক একর জমি দান করেছিলেন জাতিসংঘের সদরদপ্তর প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে পাঁচটি পরাশক্তির সমন্বয়ে ৫১ টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। চার দশক না যেতেই ১৫৯টি দেশ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হয়। যার ২৫ ভাগ চাঁদা ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের!  এমন কি এই বেশি  চাঁদা  দেয়ার কারনে যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা বেশিও দাবি করেছিলো। যা জাতিসংঘ ও পরাশক্তিগুলো মেনে নেয়নি। চায়নার সাথে মার্কিন পরাশক্তির বিরোধ নতুন নয়। ১৯৪৯ থেকে ৭২  খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোন প্রতিষ্ঠানে সহজে চীনকে সম্পৃক্ত হতে দেয়নি আমেরিকা।  অদ্ভুত বিষয় হলো, ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময়, পাকিস্তানি শাসকের মধ্যস্থতায় আমেরিকা  ও চায়নার মুখ দেখাদেখি হয়! কেন না, এ দুই পরাশক্তির অবস্থান ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
করোনাভাইরাস ইসুতে আমেরিকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থাকে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান চীনের পক্ষপাতিত্ব করেছে। যার জন্য  করোনাভাইরাস এর বিপদ সংকেত যথা সময়ে না দেয়ার কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  সহ সারা পৃথিবী এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে।

  প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে "চায়নাভাইরাস"  বলেও মন্তব্য করতে কসুর করেননি। বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থায় চাঁদা বন্ধ করা মত কান্ড,  আমেরিকার  জন্য নতুন কিছু নয়৷ এর আগেও আশির দশকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনেস্কো থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, আমেরিকার বিভিন্ন কার্যক্রমে অসন্তুষ্ট হয়ে  ১৯৮৫ সালে ৪০ তম অধিবেশনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট  মিতেঁরা  ও রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল গর্ভাচেভ আমন্ত্রণ গ্রহন করেননি।( তাদের প্রতিনিধি অবশ্য উপস্থিত ছিলো)।  পরাশক্তিগুলোর মধ্যে শীতল যুদ্ধ তখনো ছিলো; এখনো আছে এবং থাকবেও। এটাই পুঁজিবাদী  অর্থব্যাবস্থা, সমাজ ও রাষ্ট্রের ধর্ম। তাদের  বাজার দখলের লড়াই চলমান থাকবেই। করোনাভাইরাস নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিত এখন যুদ্ধে গন্ধ না পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে বাজার দখল তথা বাণিজ্য লড়াই যে একটি যুদ্ধ ডেকে আনবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
 করোনাভাইরাস জীবাণুঅস্ত্র নাকি প্রাকৃতিক এ নিয়ে আমেরিকা চায়নার বিতর্ক ও সম্পর্ক কোথায়,গিয়ে দাঁড়াবে  তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। পুঁজি কেনাবেচা ব্যাতিত ফুলে ফেঁপে উঠে না। আর কেনা বেচার জন্য চাই বাজার। আর এই বাজার দখলের প্রতিযোগিতা এবার ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। প্রথম ও ২য়,বিশ্ব যুদ্ধের সময় মার্কিন রপ্তানি কয়েক শ গুন বেড়ে গিয়েছিলো! সে দেশের আগের অর্থনীতির তুলনায়। আর এবার বিশ্ব যুদ্ধ বাধেনি। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ থেকেও ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান। যুদ্ধের সময়ও কারখানা চালু থাকে, বিশ্ব ব্যাপি  স্থল জল ও আকাশ পথে যাতায়াত এভাবে স্থবির হয়ে পরে না! যা করোনাভাইরাসের কারনে আমরা দেখতে পাচ্ছি। পরাশক্তি ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যে কোন মূল্যে এসব লোকসান  পুষিয়ে নিতে চাইবে করোনাভাইরাস উত্তরসময়ে।

উদাহারন আমাদের সামনে রয়েছে। যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধ চলার সময়। এই দুই দেশকেই একনায়কতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রকে সরাসরি  সমর্থন দিতে দেখেছে বিশ্ব। কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা তারা করেনি। তার একটি উদাহারন জাতিসংঘ মহাসচিব নির্বাচনের সময় দেখা গেছে৷ আর্জেন্টিনার নাগরিক,  প্যারেজ দ্য কুয়েলার যখন জাতিসংঘের মহাসচিব হন, তখন প্রকৃত  ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঞ্জানিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী। কিন্তু তিনি মার্কিন সরকারের পছন্দের ছিলেন না বলে। তার বদলে প্যারেজ দ্য কুয়েলার জাতিসংঘের মহাসচিব মনোনীত হয়। সুতরাং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চাঁদা বন্ধ করে দেয়াটা ছোট খাট বিষয় বলে মনে করার কোন কারন নেই।

 যে আমেরিকা ৯/১১ তে  আত্মঘাতী বিমান বোমা  হামলায় তিন হাজার নাগরিকের মৃত্যুর বদলা নিতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান তছনছ  করে দিলো। আর এখন প্রতিদিন আড়াই হাজার নাগরিক করোনাভাইরাস জনিত কারনে মরছে এবং সকল প্রকার বাণিজ্য বন্ধ! এত সহজেই এ বিষয়ে নিরব হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। আবার অন্য দিকে, চীন  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী একটি দেশ ও পরাশক্তি। তাই চায়নারাও যে মার্কিনীদের ভয়ে চুপ করে  বসে থাকবে তা ও তো হবার নয়। চায়নাকে তো আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে, কাবুল থেকে হটানোর  মত,  মুসলিম মৌলবাদীদের জেহাদে নামিয়ে কাবু করা যাবে না। কেন না, মুসলিমরা চায়নার পক্ষেই রয়েছে এখন পর্যন্ত।  উইঘুরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয়ার পরও। আবার আচানক রুশপন্থী বাম ঘরণার রাজনৈতিক ব্যাক্তিরাও নাকি এখন চায়নার পক্ষে কথা বলে চলছেন!

 তবে আমার মনে হয়, করোনাভাইরাস উত্তর পৃথিবী যেমন ক্ষুধার ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, তেমনি একটি বড় যুদ্ধের মুখোমুখিও হতে পারে। বদলে যেতে পারে সমাজ, রাষ্ট্রের মানচিত্র। তেমনি বদলে যেতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনা ব্যাবস্থা চিন্তা- চেতনা, দর্শন -রাজনীতি অর্থনীতি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: