ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:
আদি শঙ্কারাচার্যের পুর্ব পর্বে বর্নিত কাহিনীটি কষ্ট কল্পিত! সম্ভবতঃ পরবর্তীকালে সংযোজিত! কারন শঙ্করাচার্য যুগবতার এবং আজীবন ব্রক্ষ্মচারী!
উভয়ভারতী সমাধান সূত্র উপস্হাপন করলেন! তিনি শঙ্করাচার্যের অনুমতি নিয়ে দুটি প্রস্তাব দিলেন! প্রথমতঃ তাঁর স্বামী আচার্য মন্ডন মিশ্র যেহেতু তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন তাই এই মূহূর্ত থেকে আশ্রম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহন করবেন! দ্বিতীয়তঃ শঙ্করাচার্য কামশাস্ত্র নিয়ে উভয়ভারতীর সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ন হতে অপারগ তাই ভারতবর্ষে তিনি তাঁর ইচ্ছামতো চারটি অদ্বৈত বেদান্তের মঠ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন! কিন্তু তাঁর অনুশাসন কেবলমাত্র সংসারত্যাগী দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যেই প্রযোজ্য হবে গার্হস্হ জীবন যাপনকারী সংসারীদের উপর কোন অনুশাসন কার্যকরী করা যাবে না!
শঙ্করাচার্য নিরব রইলেন! উভয়ভারতী পুনরায় বললেন," ভেবে দেখুন মহর্ষি, আপনার সিদ্ধান্ত যদি যদি সারা ভারতে প্রযোজ্য হয় আর মানুষ নির্বিচারে গ্রহন করে অচিরেই ভারতবর্ষ মনুষ্য- শূন্য হয়ে যাবে! আর ভবিষ্যতে শঙ্করাচার্যের অভাবে চতুরাশ্রম ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে!
কাশীর পন্ডিত সমাজ হটীর দ্বরস্হ কারন অদ্বৈত বেদান্তের একটি মঠ কাশীধামে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী যোশীমঠের শঙ্করাচার্য! পন্ডিত সমাজ চান তাঁকে আমন্ত্রন করে কাশীধামে আনা হোক এবং তর্কযুদ্ধ না করে ঘরোয়া আলোচনায় তাঁকে বোঝানো হোক কি কারনে হাজার বছর আগে শঙ্করাচার্য ভারতের চারটি প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন! কেনই বা অদ্বৈতবেদান্ত মঠের অনুশাসন শুধুমাত্র দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ! গৃহীদের মধ্যে নয়!
কাশীর সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিত মহামহোপাধ্যায় রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন হটীকে বললেন, " কাশীর পন্ডিত সমাজ তোকেই এই দ্বায়িত্ব দিয়েছে "
হটী ইতস্হতঃ করে বললেন," আমি তো এখন তর্ক সভায় যাইনা "
" এটা আমার আদেশ " বললেন তর্কপঞ্চানন!
হটী আদেশ শিরোধার্য করে নিল!
আশ্রমে সাজো সাজো রব পড়ে গেল! যোশীমঠের শঙ্করাচার্য আসছেন এই আশ্রমে!
সৌম্যদর্শন পৌঢ় সন্ন্যাসী কাশীর ঘাটে প্রতিক্ষারত! এমন সময় ঈশেন কৈবর্ত নৌকা নিয়ে ঘাটে এসে সন্ন্যাসীকে সাষ্ঠাঙ্গে প্রনাম করল! প্রতি নমস্কার করলেন সন্ন্যাসী! ছিপ নৌকা গঙ্গাবক্ষে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে এগিয়ে যেতে লাগল!
ঈশেন যেতে যেতে নিজের জীবনের কথা, হটী কিভাবে কাশীতে এলো! কিভাবে পুরন্দরের হাত থেকে রক্ষা পেল! কাশীতে সুশাসন ফিরে এলো! সে সোঁয়াই গ্রাম থেকে কেন চলে এসে প্রথম কাশীরাজের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল! পরে কিভাবে ডাকাত সর্দার হয়ে গেল এবং আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো! সব বলল, আরো শোনালো তাঁদের গাঁয়ের কোবরাজ ঠাকুরের মেয়ে হটীর সংঘর্যপূর্ন চাঞ্চল্যকর জীবন কাহিনী এবং কিভাবে কাশীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন সব কথা বলল, সব! হঠাৎ ঈশেনের খেয়াল হয়! যাঁকে সে এতকথা বলছে সে তো সন্ন্যাসী! এসব তাঁর কাছে বলা সম্পুর্ন অর্থহীন!
হঠাৎ সন্ন্যাসী ঠাকুর ঈশানকে জিজ্ঞাসা করেন " তোমার আসল বাড়ী কোথায়? বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রামে?"
" আজ্ঞে'হ কর্তা! কিন্তু কেন?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে ঈশান!
" সোঁয়াই গাঁয়ের জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ীর কথা মনে আছে ?" আন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন সন্ন্যাসী!
হতবাক হয়ে ঈশেন বলে," হ্যাঁ ঠাকুর মনে আছে! কিন্তু আপনি তাঁর কথা কি করে জানলেন?"
" আমিই তার একমাত্র সন্তান সুভাপ্রসন্ন!" বলেন সন্ন্যাসী!
এরপর দুজনেই চুপচাপ! তীরে নৌকা যখন ভিড়লো তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নেমেছে! ওরা আশ্রমে এসে পৌঁছালো! রমারঞ্জন সন্ন্যাসীর পদধূলি মাথায় নিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন!
পরদিন দুপুরে কাশীতে এক সমাবেশে রাজা রামমোহন রায় ' সতীদাহ নিবরনের ' বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন! সেই সভায় উপস্হিত ছিলেন কাশীর বহু জ্ঞানীগুনিজন , উপস্হিত ছিলেন রমারঞ্জন ভট্টশালী এবং যোশী মঠের সন্ন্যাসী! সেখানেই সকলে জানলেল ইংরেজ সরকার আইন করে ' সতীদাহ প্রথা' বন্ধ করেছেন!
সভার চতুর্দিকে সন্ন্যাসীর দুজোড়া চোখ শুধু একজনকে খুঁজেছে, হটী তাঁর সতীর্থ, বাল্যের সখী, প্রেয়সী! না সে আসেনি! কিন্তু কেন? বারবার তাঁর মন জানতে চেয়েছে!
আগামীকাল হটী বিদ্যালঙ্কারের সাথে তাঁর তর্কযুদ্ধের দিন ধার্য হয়েছে!! ঘরে ফিরে প্রদীপের আলোয় সন্ন্যাসী দু'টি চিঠি লিখলেন! প্রথমটি রাম প্রসাদ তর্কপঞ্চানন ও বিদ্যার্নবদের উদ্দেশে দ্বিতীয়টি হটী বিদ্যালঙ্কারের উদ্দেশ্যে! চিঠি দুটি খামে ভরে মুখ বন্ধ করলেন!
পরদিন সকালে রোহিনী খামদুটি হটীর হাতে দিয়ে গেল!
প্রথম চিঠিতে রাম প্রসাদ তর্কপঞ্চানন ও বিদ্যার্নব মহাশয়কে উদ্দেশ্য করে লেখাঃ-
' তর্কসভার আর প্রয়োজন নাই! আপনাদের ও বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ার সাথে আমার মতের কোন অমিল নাই! যদিও আমি আদি শঙ্করাচার্যের পন্হায় বিশ্বাসী সন্ন্যাসী! তবুও হটী বিদ্যালঙ্কারের অভিমতের সাথে আমিও সহমত পোষন করি! আমি ও বিদ্যালঙ্কার সতীর্থ! আমরা একই আচার্যের সান্নিধ্যে, একই মননে ও মন্ত্রে দীক্ষিত! তাই সর্বসমক্ষে তর্কযুদ্ধ দুজনের পক্ষেই পীড়াদায়ক! আগামী বুধবার শুভদিন - সেদিন পূর্বাহ্নেই আমি যোশীমঠ যাত্রা করিব!
দ্বিতীয় চিঠিটি হটীর উদ্দেশ্যেঃ-
হটী বিদ্যালঙ্কার শ্রদ্ধাপদেষু,
কল্যানীয়া প্রিয় মঞ্জু ,
বহুদিন পর বহু তীর্থ ঘুরে, জীবনের বহু বছর অতিক্রম করে আজ তোমার খুব কাছে এসেছি! তুমি এতো কাছে আছো ভেবে রোমাঞ্চিত বোধ করছি! লোকারন্যে তোমার সাথে দেখা করা অসৌজন্য! তুমি না চাইলে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো না!
আজ তোমাকে কিছু কথা না জানালে মনে একটা শূন্যতা নিয়ে ইহকাল ত্যাগ করতে হবে!তাই না লিখে পারলাম না!
জীবনযুদ্ধে তুমি জয়ী মঞ্জু, শত প্রতিকূলতার মধ্যে কঠিন যুদ্ধে তুমি পরাস্ত হওনি , সব ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছো! তুমি নিজে প্রদীপের মতো জ্বলে শত শত প্রানে জ্ঞানের, চেতনার আলো জ্বালিয়েছো! তোমার কথা ঈশান, রমারঞ্জন, রোহিনীর কাছে শুনে আনন্দে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছে!
প্রেমের আলো নিজের অন্তরের দীপশিখা জ্বালায়, সেই শিখা পথচলার আলো দেখায়! হাজার মনে প্রদীপ জ্বালায়! আচার্য বলতেন " আত্মদীপ ভবো!"
তুমি আত্মদীপ হয়েছো মঞ্জু, তুমি নিজের জীবন সার্থক করেছো!
তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট! তবুও তোমাকে প্রনাম করতে ইচ্ছা করে! ভালবাসা নিও -
ইতি-
তোমার শুভদা
আজ আশ্রমে বহু মানুষ উপস্হিত! যে,মানুষটির অসুস্হার খবরে সমগ্র কাশী উদ্ভিগ্ন সেই,না পন্ডিতা হটী বিদ্যালঙ্কার শেষ শয্যায় শায়িতা! সাধারন মানুষ তাঁর আরোগ্য কামনায় দেবতার কাছে,মানত করছে, প্রসাদী ফুল নিয়ে আসছে! কে উপস্হিত নেই? কাশীর পন্ডিত সমাজের,মাথা বিদ্যার্নব, বিদ্যাচঞ্চু, তর্কপঞ্চানন, অধ্যাুপক, অধ্যক্ষ আরও বহু জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি!
এক সময় হটী,রোহিনীকে বলেন," তাঁকে একবার আসতে বল!"
রোহিনী জানতে চায়," কার কথা বলছ মা ?"
ক্ষীনকন্ঠে হটী বলে," শুভদা , আমার গুরু, পরম গুরু, আবাল্যের বন্ধু,যোশীমঠের সন্ন্যাসীঠাকুর! তাঁকে একবার ডেকে দে!
হটীর শয্যার পাশে দাঁড়ালেন শুভা প্রসন্ন! হটী তাঁর হাতখানি নিয়ে নিজের কপালে, গালে ঠোঁটে , মুখে বোলালো! তারপর বলল," আজ আমার পরম সুখের দিন, শুভদা! বড় শান্তির দিন!এমন শান্তি আমি জীবনে পাইনি! কিন্তু এতদিন পর তুমি এলে তোমার একটু সেবাও করতে পারলাম না ! দাও তোমার একটু পায়ের ধুলো দাও! উঠে নেব সে ক্ষমতাও আমার নেই!
শুভাপ্রসন্ন তার সারা গায়ে হাত বুলাতে লাগল! শুভাপ্রসন্নর চোছে জল!
নিস্তব্ধতা ভেঙে হটী তার শুভদাকে বলল," তুমি এদের দেখো! আর চেষ্টা করো প্রতিটি বাড়ীতে যেন নারী- শিক্ষার আলো পৌঁছায় ! আর সম্ভব হলে সোঁয়াই গ্রামে একটা মেয়ের বিদ্যালয় খুলবে!"
" মঞ্জু, তুমি একটা কথা জেনে যাও! সতীদাহ প্রথা আইন করে বন্ধ হয়েছে!" শুভাপ্রসন্ন বললেন!
হটীর মুখমৃ্ডল এক অনির্বচনীয় খুশীতে ভরে উঠল!ঠোঁটের কোনে দেখা গেল এক চিলতে হাসির ঝিলিক! পরম প্রিয়,মনের মানুষ, জন্মজন্মান্তরের কাঙ্খিত পুরুষ প্রিয় শুভদার হাতে হাত রেখে চোখ বুজে ভারতের নারী- শিক্ষা ও নারী- অধিকার আন্দোলনের পথিকৃত ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালঙ্কার অনন্তধামে চলে গেলেন! অবসান হ'লো একটি যুগের!
(ক্রমশঃ) তবে হটী পর্ব শেষ।
*** হটী বিদ্যালঙ্কার বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম - ২ নং ব্লকের বুদবুদ থানার সোঁয়াই গ্রামের কন্যা! তাঁর পৈত্রিক ভিটেটি ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছে!তিনি ভারতের প্রথম মহিলা,বিদ্যালঙ্কার এবং নারী শিক্ষার পথিকৃৎ!কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়! দুর্গাপুর মহকুমা বা দুই বর্ধমান জেলার এমন কি সোঁয়াই গ্রামের বহু মানুষ হটীর সম্পর্কে কিছুই জানেন না! তাই আমার মনে হয়েছে ভাবী প্রজন্মেকে হটী - সম্পর্কে জানানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য! এজন্য আমি হটী বিদ্যালঙ্কার -এর উপর একটি তথ্যচিত্র ও একটি স্বল্প দৈর্ধ্যের কাহিনী চিত্র নির্মানে আগ্রহী ! কিন্তু এর জন্য বেশ কিছু আর্থিক সহযোগীতা প্রয়োজন! কোন সংস্হা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এগিয়ে এলে কৃতঞ্জ থাকবো!
এই হোয়াটসআপ নং - যোগাযোগ করতে পারেন -9434114693
আদি শঙ্কারাচার্যের পুর্ব পর্বে বর্নিত কাহিনীটি কষ্ট কল্পিত! সম্ভবতঃ পরবর্তীকালে সংযোজিত! কারন শঙ্করাচার্য যুগবতার এবং আজীবন ব্রক্ষ্মচারী!
উভয়ভারতী সমাধান সূত্র উপস্হাপন করলেন! তিনি শঙ্করাচার্যের অনুমতি নিয়ে দুটি প্রস্তাব দিলেন! প্রথমতঃ তাঁর স্বামী আচার্য মন্ডন মিশ্র যেহেতু তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন তাই এই মূহূর্ত থেকে আশ্রম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহন করবেন! দ্বিতীয়তঃ শঙ্করাচার্য কামশাস্ত্র নিয়ে উভয়ভারতীর সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ন হতে অপারগ তাই ভারতবর্ষে তিনি তাঁর ইচ্ছামতো চারটি অদ্বৈত বেদান্তের মঠ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন! কিন্তু তাঁর অনুশাসন কেবলমাত্র সংসারত্যাগী দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যেই প্রযোজ্য হবে গার্হস্হ জীবন যাপনকারী সংসারীদের উপর কোন অনুশাসন কার্যকরী করা যাবে না!
শঙ্করাচার্য নিরব রইলেন! উভয়ভারতী পুনরায় বললেন," ভেবে দেখুন মহর্ষি, আপনার সিদ্ধান্ত যদি যদি সারা ভারতে প্রযোজ্য হয় আর মানুষ নির্বিচারে গ্রহন করে অচিরেই ভারতবর্ষ মনুষ্য- শূন্য হয়ে যাবে! আর ভবিষ্যতে শঙ্করাচার্যের অভাবে চতুরাশ্রম ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে!
কাশীর পন্ডিত সমাজ হটীর দ্বরস্হ কারন অদ্বৈত বেদান্তের একটি মঠ কাশীধামে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী যোশীমঠের শঙ্করাচার্য! পন্ডিত সমাজ চান তাঁকে আমন্ত্রন করে কাশীধামে আনা হোক এবং তর্কযুদ্ধ না করে ঘরোয়া আলোচনায় তাঁকে বোঝানো হোক কি কারনে হাজার বছর আগে শঙ্করাচার্য ভারতের চারটি প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন! কেনই বা অদ্বৈতবেদান্ত মঠের অনুশাসন শুধুমাত্র দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ! গৃহীদের মধ্যে নয়!
কাশীর সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিত মহামহোপাধ্যায় রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন হটীকে বললেন, " কাশীর পন্ডিত সমাজ তোকেই এই দ্বায়িত্ব দিয়েছে "
হটী ইতস্হতঃ করে বললেন," আমি তো এখন তর্ক সভায় যাইনা "
" এটা আমার আদেশ " বললেন তর্কপঞ্চানন!
হটী আদেশ শিরোধার্য করে নিল!
আশ্রমে সাজো সাজো রব পড়ে গেল! যোশীমঠের শঙ্করাচার্য আসছেন এই আশ্রমে!
সৌম্যদর্শন পৌঢ় সন্ন্যাসী কাশীর ঘাটে প্রতিক্ষারত! এমন সময় ঈশেন কৈবর্ত নৌকা নিয়ে ঘাটে এসে সন্ন্যাসীকে সাষ্ঠাঙ্গে প্রনাম করল! প্রতি নমস্কার করলেন সন্ন্যাসী! ছিপ নৌকা গঙ্গাবক্ষে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে এগিয়ে যেতে লাগল!
ঈশেন যেতে যেতে নিজের জীবনের কথা, হটী কিভাবে কাশীতে এলো! কিভাবে পুরন্দরের হাত থেকে রক্ষা পেল! কাশীতে সুশাসন ফিরে এলো! সে সোঁয়াই গ্রাম থেকে কেন চলে এসে প্রথম কাশীরাজের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল! পরে কিভাবে ডাকাত সর্দার হয়ে গেল এবং আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো! সব বলল, আরো শোনালো তাঁদের গাঁয়ের কোবরাজ ঠাকুরের মেয়ে হটীর সংঘর্যপূর্ন চাঞ্চল্যকর জীবন কাহিনী এবং কিভাবে কাশীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন সব কথা বলল, সব! হঠাৎ ঈশেনের খেয়াল হয়! যাঁকে সে এতকথা বলছে সে তো সন্ন্যাসী! এসব তাঁর কাছে বলা সম্পুর্ন অর্থহীন!
হঠাৎ সন্ন্যাসী ঠাকুর ঈশানকে জিজ্ঞাসা করেন " তোমার আসল বাড়ী কোথায়? বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রামে?"
" আজ্ঞে'হ কর্তা! কিন্তু কেন?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে ঈশান!
" সোঁয়াই গাঁয়ের জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ীর কথা মনে আছে ?" আন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন সন্ন্যাসী!
হতবাক হয়ে ঈশেন বলে," হ্যাঁ ঠাকুর মনে আছে! কিন্তু আপনি তাঁর কথা কি করে জানলেন?"
" আমিই তার একমাত্র সন্তান সুভাপ্রসন্ন!" বলেন সন্ন্যাসী!
এরপর দুজনেই চুপচাপ! তীরে নৌকা যখন ভিড়লো তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নেমেছে! ওরা আশ্রমে এসে পৌঁছালো! রমারঞ্জন সন্ন্যাসীর পদধূলি মাথায় নিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন!
পরদিন দুপুরে কাশীতে এক সমাবেশে রাজা রামমোহন রায় ' সতীদাহ নিবরনের ' বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন! সেই সভায় উপস্হিত ছিলেন কাশীর বহু জ্ঞানীগুনিজন , উপস্হিত ছিলেন রমারঞ্জন ভট্টশালী এবং যোশী মঠের সন্ন্যাসী! সেখানেই সকলে জানলেল ইংরেজ সরকার আইন করে ' সতীদাহ প্রথা' বন্ধ করেছেন!
সভার চতুর্দিকে সন্ন্যাসীর দুজোড়া চোখ শুধু একজনকে খুঁজেছে, হটী তাঁর সতীর্থ, বাল্যের সখী, প্রেয়সী! না সে আসেনি! কিন্তু কেন? বারবার তাঁর মন জানতে চেয়েছে!
আগামীকাল হটী বিদ্যালঙ্কারের সাথে তাঁর তর্কযুদ্ধের দিন ধার্য হয়েছে!! ঘরে ফিরে প্রদীপের আলোয় সন্ন্যাসী দু'টি চিঠি লিখলেন! প্রথমটি রাম প্রসাদ তর্কপঞ্চানন ও বিদ্যার্নবদের উদ্দেশে দ্বিতীয়টি হটী বিদ্যালঙ্কারের উদ্দেশ্যে! চিঠি দুটি খামে ভরে মুখ বন্ধ করলেন!
পরদিন সকালে রোহিনী খামদুটি হটীর হাতে দিয়ে গেল!
প্রথম চিঠিতে রাম প্রসাদ তর্কপঞ্চানন ও বিদ্যার্নব মহাশয়কে উদ্দেশ্য করে লেখাঃ-
' তর্কসভার আর প্রয়োজন নাই! আপনাদের ও বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ার সাথে আমার মতের কোন অমিল নাই! যদিও আমি আদি শঙ্করাচার্যের পন্হায় বিশ্বাসী সন্ন্যাসী! তবুও হটী বিদ্যালঙ্কারের অভিমতের সাথে আমিও সহমত পোষন করি! আমি ও বিদ্যালঙ্কার সতীর্থ! আমরা একই আচার্যের সান্নিধ্যে, একই মননে ও মন্ত্রে দীক্ষিত! তাই সর্বসমক্ষে তর্কযুদ্ধ দুজনের পক্ষেই পীড়াদায়ক! আগামী বুধবার শুভদিন - সেদিন পূর্বাহ্নেই আমি যোশীমঠ যাত্রা করিব!
দ্বিতীয় চিঠিটি হটীর উদ্দেশ্যেঃ-
হটী বিদ্যালঙ্কার শ্রদ্ধাপদেষু,
কল্যানীয়া প্রিয় মঞ্জু ,
বহুদিন পর বহু তীর্থ ঘুরে, জীবনের বহু বছর অতিক্রম করে আজ তোমার খুব কাছে এসেছি! তুমি এতো কাছে আছো ভেবে রোমাঞ্চিত বোধ করছি! লোকারন্যে তোমার সাথে দেখা করা অসৌজন্য! তুমি না চাইলে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো না!
আজ তোমাকে কিছু কথা না জানালে মনে একটা শূন্যতা নিয়ে ইহকাল ত্যাগ করতে হবে!তাই না লিখে পারলাম না!
জীবনযুদ্ধে তুমি জয়ী মঞ্জু, শত প্রতিকূলতার মধ্যে কঠিন যুদ্ধে তুমি পরাস্ত হওনি , সব ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছো! তুমি নিজে প্রদীপের মতো জ্বলে শত শত প্রানে জ্ঞানের, চেতনার আলো জ্বালিয়েছো! তোমার কথা ঈশান, রমারঞ্জন, রোহিনীর কাছে শুনে আনন্দে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছে!
প্রেমের আলো নিজের অন্তরের দীপশিখা জ্বালায়, সেই শিখা পথচলার আলো দেখায়! হাজার মনে প্রদীপ জ্বালায়! আচার্য বলতেন " আত্মদীপ ভবো!"
তুমি আত্মদীপ হয়েছো মঞ্জু, তুমি নিজের জীবন সার্থক করেছো!
তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট! তবুও তোমাকে প্রনাম করতে ইচ্ছা করে! ভালবাসা নিও -
ইতি-
তোমার শুভদা
আজ আশ্রমে বহু মানুষ উপস্হিত! যে,মানুষটির অসুস্হার খবরে সমগ্র কাশী উদ্ভিগ্ন সেই,না পন্ডিতা হটী বিদ্যালঙ্কার শেষ শয্যায় শায়িতা! সাধারন মানুষ তাঁর আরোগ্য কামনায় দেবতার কাছে,মানত করছে, প্রসাদী ফুল নিয়ে আসছে! কে উপস্হিত নেই? কাশীর পন্ডিত সমাজের,মাথা বিদ্যার্নব, বিদ্যাচঞ্চু, তর্কপঞ্চানন, অধ্যাুপক, অধ্যক্ষ আরও বহু জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি!
এক সময় হটী,রোহিনীকে বলেন," তাঁকে একবার আসতে বল!"
রোহিনী জানতে চায়," কার কথা বলছ মা ?"
ক্ষীনকন্ঠে হটী বলে," শুভদা , আমার গুরু, পরম গুরু, আবাল্যের বন্ধু,যোশীমঠের সন্ন্যাসীঠাকুর! তাঁকে একবার ডেকে দে!
হটীর শয্যার পাশে দাঁড়ালেন শুভা প্রসন্ন! হটী তাঁর হাতখানি নিয়ে নিজের কপালে, গালে ঠোঁটে , মুখে বোলালো! তারপর বলল," আজ আমার পরম সুখের দিন, শুভদা! বড় শান্তির দিন!এমন শান্তি আমি জীবনে পাইনি! কিন্তু এতদিন পর তুমি এলে তোমার একটু সেবাও করতে পারলাম না ! দাও তোমার একটু পায়ের ধুলো দাও! উঠে নেব সে ক্ষমতাও আমার নেই!
শুভাপ্রসন্ন তার সারা গায়ে হাত বুলাতে লাগল! শুভাপ্রসন্নর চোছে জল!
নিস্তব্ধতা ভেঙে হটী তার শুভদাকে বলল," তুমি এদের দেখো! আর চেষ্টা করো প্রতিটি বাড়ীতে যেন নারী- শিক্ষার আলো পৌঁছায় ! আর সম্ভব হলে সোঁয়াই গ্রামে একটা মেয়ের বিদ্যালয় খুলবে!"
" মঞ্জু, তুমি একটা কথা জেনে যাও! সতীদাহ প্রথা আইন করে বন্ধ হয়েছে!" শুভাপ্রসন্ন বললেন!
হটীর মুখমৃ্ডল এক অনির্বচনীয় খুশীতে ভরে উঠল!ঠোঁটের কোনে দেখা গেল এক চিলতে হাসির ঝিলিক! পরম প্রিয়,মনের মানুষ, জন্মজন্মান্তরের কাঙ্খিত পুরুষ প্রিয় শুভদার হাতে হাত রেখে চোখ বুজে ভারতের নারী- শিক্ষা ও নারী- অধিকার আন্দোলনের পথিকৃত ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালঙ্কার অনন্তধামে চলে গেলেন! অবসান হ'লো একটি যুগের!
(ক্রমশঃ) তবে হটী পর্ব শেষ।
*** হটী বিদ্যালঙ্কার বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম - ২ নং ব্লকের বুদবুদ থানার সোঁয়াই গ্রামের কন্যা! তাঁর পৈত্রিক ভিটেটি ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছে!তিনি ভারতের প্রথম মহিলা,বিদ্যালঙ্কার এবং নারী শিক্ষার পথিকৃৎ!কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়! দুর্গাপুর মহকুমা বা দুই বর্ধমান জেলার এমন কি সোঁয়াই গ্রামের বহু মানুষ হটীর সম্পর্কে কিছুই জানেন না! তাই আমার মনে হয়েছে ভাবী প্রজন্মেকে হটী - সম্পর্কে জানানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য! এজন্য আমি হটী বিদ্যালঙ্কার -এর উপর একটি তথ্যচিত্র ও একটি স্বল্প দৈর্ধ্যের কাহিনী চিত্র নির্মানে আগ্রহী ! কিন্তু এর জন্য বেশ কিছু আর্থিক সহযোগীতা প্রয়োজন! কোন সংস্হা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এগিয়ে এলে কৃতঞ্জ থাকবো!
এই হোয়াটসআপ নং - যোগাযোগ করতে পারেন -9434114693
Post A Comment: