জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার ও চিত্রশিল্পী, কলকাতা:

সারা বিশ্ব আজ এক চরম সংকটের মুখোমুখি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংকট নতুন নয়। একটু ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক। আমাদের মহামারী আর দুর্ভিক্ষের ইতিহাসের দিকে।

#বসন্ত: ১৮৩৭ থেকে ১৮৫১ এর মধ্যে কলকাতায় বসন্তরোগে প্রায় ১১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। পরবর্তী আঠেরো বছরের এক‌ই কারণে মৃত্যু হয় ৯,৫৪৯ জন মানুষের। ১৮৬৯ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী উত্তর ভারতের দোয়াব অঞ্চলের ৯৫% মানুষ কখনও না কখনও বসন্ত বা মসুরিকা রোগে আক্রান্ত হতো। এই রোগের সামাজিক বিস্তার ও প্রভাব এত‌ই ব্যাপক ছিল যে চিকিৎসাজনিত বিশেষ প্রতিকার না থাকায় লোকায়ত দেবী শীতলাকে তুষ্ট করার মধ্যে দিয়ে এই ব্যাধির নিরাময় সন্ধান করা হতো। এই প্রবণতা উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের সর্বত্র‌ই দৃশ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে Jenner কতৃক বসন্ত রোগের টিকা আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত দেশীয় variolation পদ্ধতিতে সুস্থ ছেলেমেয়েদের হাতে ধারালো লোহার প্রবেশ ঘটিয়ে এবং পূর্বে সংগৃহীত তুলোয় জড়ানো বসন্ত রোগের পুঁজ এর শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটানো হতো। এইভাবেই প্রতিষেধক দেবার কাজ চলতো। এবং যারা এই কাজ করতেন তারাই ঐ সময় থেকে 'টিকাদার' নামে পরিচিত হতে থাকেন।

#কলেরা: ১৮১৭ সাল থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে সারা দেশে কলেরায় অন্তত ১.৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১৮৬৫ থেকে ১৯৪৭ এ দেশ স্বাধীন হ‌ওয়া পর্যন্ত সময়কালে আরো ২.৩ কোটি মানুষ এই রোগের প্রাণ হারিয়েছিল। ১৮৬৭ তে এই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে। আড়াই লক্ষ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে অর্ধেক মানুষের‌ই মৃত্যু ঘটে। হরিদ্বার, পুরী, এলাহাবাদ তিরুপতি, কাঞ্চীপুরম প্রভৃতি তীর্থস্থান থেকে এই রোগ মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯২ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকার কলেরা প্রতিরোধে হরিদ্বারে মহাবারুণী মেলা ভেঙে দিয়ে ২,০০০ তীর্থযাত্রীকে ফিরিয়ে দেয়।

#ম্যালেরিয়া: ১৮৮৯ এ বাংলার Sanitary Commissioner এর  দেওয়া হিসেব অনুযায়ী তৎকালীন বাংলার তিন চতুর্থাংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ‌ই ছিল ম্যালেরিয়া জ্বর এবং প্রায় প্রতি বছরই অন্তত ১০ লক্ষ মানুষ মারা যেত এই রোগে।
#প্লেগ: ১৮৯৬ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যবর্তী সময়কালে বুবনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে কমবেশি ১.২ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯০২ সালে ৫ লক্ষাধিক ও ১৯০৪ সালে ১০ লক্ষাধিক মানুষের জীবনহানি হয়। তবে প্রাণহানির তিন চতুর্থাংশ‌ই ঘটেছিল পাঞ্জাব, ইউনাইটেড প্রভিন্স ও বম্বেতে। ১৮৯৭ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বোম্বাইয়ের জনসংখ্যার ৮.৫ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৩.৮ লক্ষ মানুষ এবং ১৮৯২ এর এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতার এক চতুর্থাংশ মানুষ প্লেগ ও প্লেগ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপের ভয়ে শহর ত্যাগ করে পলায়ন করে। ১৮৯৭ এর ৪ ফেব্রুয়ারি লর্ড এলগিনের উদ্যোগে Epidemic Disease Act পাশ হয়। এই সর্বভারতীয় আইনের বলে সরকার যে কোনো যানবাহন ও যাত্রীর তল্লাসী নিতে পারত। এছাড়াও, প্লেগে সন্দেহভাজনদের পৃথক ও আটক করা সহ চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত।

#দুর্ভিক্ষ: ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এলাকায় ১ কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে মধ্যপ্রদেশ, রাজপুতানা, পাঞ্জাব ও বোম্বাইয়ে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে কমপক্ষে ১২ লক্ষ মানুষ মারা যান। ১৮৫৪ তে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের মতে ১৮৭৭ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত সময়কালে দুর্ভিক্ষের কারণে দেশে ১.৫ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষেও  বাংলায় ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যান।

এছাড়াও, বৃটিশ রাজত্বে সারা দেশে শতাধিক মহামারী ও দুর্ভিক্ষের ঘটনায় কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারান। ১৮৭২ সালে ভারতবর্ষে সংঘটিত প্রথম আদমসুমারি অনুযায়ী এ সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২০.৬১ কোটি। এই সুমারি ছিল আংশিক। মনে করা যেতে পারে তখন দেশের জনসংখ্যা আরো কিছুটা বেশি ছিল কারণ ১৮৮১ এর জনগণনা অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ছিল ২৫ কোটির সামান্য বেশি। কাজেই এ কথা সহজেই অনুমেয় যে মোট জনসংখ্যার নিরিখে শতাংশের বিচারে কী পরিমাণ মানুষ এইসব মহামারী ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কখনো কখনো এই পরিমাণ ছিল ১০% বা তার‌ও বেশি। আজকের দিনে এই ঘটনা ঘটলে ১৩ কোটি মানুষ মারা পড়তেন। শুধুমাত্র কল্পনা করাটাই অসম্ভব কঠিন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, 'মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি'। মহামারী, দুর্ভিক্ষ, এসব মানবসভ্যতার ইতিহাসে নতুন নয় তবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের প্রজন্মের কাছে একেবারেই নতুন। সমগ্র বিশ্বেই আজ থরহরি কম্প অবস্থা। মধ্যযুগীয় সভ্যতার পীঠস্থান ইটালি আজ এক 'পদচিহ্ন' গ্রাম। অভিন্ন অবস্থা স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, চিন সর্বত্র। পৃথিবীর প্রায় দুশোটি দেশে করোনারি হাহাকার। আক্রান্ত দশ লক্ষের কাছাকাছি।

করোনা মারণরোগ না হলেও ভয়াবহ সংক্রামক। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও মধুমেহ রোগীদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসা হলে মৃত্যুর হার পাঁচ শতাংশের নিচে হলেও চিকিৎসা না হলে সেই হার ভয়াবহ হতে বাধ্য। এখন‌ই অনেক জায়গায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক পাওয়া যাচ্ছে না। রোগ সর্বাত্মক হলে অবস্থা কী হবে? তার উপরে আছে আমাদের সবুজের দেশে অবুঝের বোঝা। হস্তিমূর্খের দল এলাকা দর্শনে বেরোচ্ছে, তিরুপতিতে ভিড় জমাচ্ছে, নিজামুদ্দিনে ধর্ম সম্মেলন করছে, বাজারে, চায়ের দোকানে, আড্ডায়, পানাহারে, রসেবশে বেশ রসিয়েই আছে।

বস্তুত, পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ সত্ত্বেও অন্ততঃ এক থেকে দুমাস আগেই আন্তর্জাতিক বিমান, সড়কযান ও জাহাজ বন্ধ করলে এই দুর্গতি হতো না। মাত্র দুঘন্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক গরীব মানুষ নিরাশ্রয় পরিযায়ী শ্রমিককে জীবনঘাতী দুর্দশার মধ্যে ফেলে না দিয়ে ৪৮ ঘন্টা আগে নোটিশ দিলে মানুষ ঘরে ফেরার সুযোগ পেত। তাদের‌ও ঘরসংসার আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরে ফেরার সুযোগ না পেলে তারা স্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে ভিড় জমাবেই। তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি, এইই ঢের।

রাজ্য সরকার তুলনায় অনেক বেশি প্রস্তুত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম ভেঙেছে বিলম্বে। তবে তারপরে তারাও যথেষ্ট তৎপর হয়ে উঠেছে। আজ সমালোচনার সময় নয়। কী হয়নি তার হিসেব নিয়ে বসলে কী করতে হবে তার হিসেব আর করা হবে না। দুই সরকার‌ই এখন সক্রিয়। তাদের নির্দেশিকা মানতেই হবে। বহু মানুষ লকডাউন মানছেন না। মানুষ সচেতন না হলে মুশকিল। পুলিশ বা মিলিটারির উপর কর্তৃত্ব দিলে সেটি অপব্যবহারের সম্ভাবনা প্রবল। তাই শিক্ষা আর সচেতনতাই একমাত্র পথ। (চলবে)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: