আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

আমরা নিজেদের সভ্য বলতে খুব ভালোবাসি । সভ্য যে অনেকখানি হইনি, তা নয়, কিন্তু কতটুকু হয়েছি? তাই কতটা সভ্য হয়েছি তার চেয়ে জেনে নেয়া ভাল ‘সভ্য হওয়া’ আসলে কাকে বলে । এর একটা সহজ উত্তর দিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিঙ্গার । তিনি বলেছিলেন সভ্য হওয়া মানে ছেনি দিয়ে নিজের ভেতরের আদিম প্রবৃত্তিগুলি কেটে ফেলা । আদিম প্রবৃত্তি কি এটা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না । যা কিছু হিংস্র, তার সবকিছুই এই প্রবৃত্তির অংশ ।

সভ্য ভাষায় একটা সহজ উদাহরণ দিচ্ছি এই প্রবৃত্তির, তা হল কোন কিছু ‘আমার অধিকারে’ কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করা এবং এটা করতে গিয়ে যা করা হয় । আদিম বলছি বটে, তবে বলা ভাল আদিম সাম্যাবস্থা ভেঙে পড়ার পর যে সমাজ ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো এবং মানুষ তার সেই ‘আমার অধিকারে’ রাখার প্রবৃত্তি ধারণ করলো, সেগুলি নির্দেশ করাই ভাল । এখন এই ‘আমার অধিকারে’ রাখার জন্য মানুষ কি করতে শুরু করলো ?

প্রথমেই যেটা করলো তা হল শক্তি প্রয়োগ । যে শক্তিশালী সে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে ঘায়েল করে নিজের দাস বা অধিনস্ত বানিয়ে ফেললো । এইভাবে একে অপরের সংগে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হল মানুষ । শুরু হল রক্তপাত । সেই রক্তপাত এখনো থামেনি । এটা করতে গিয়ে এই প্রজাতি অর্জন করেছে নৃশংসতার যা কিছু বৈশিষ্ট্য, তার সবকিছু । সে খুন করলো, সে অপহরণ করলো, সে গুম করলো, সে জবরদখল করলো, সে বাস্তুহারা করলো । সে ষড়যন্ত্র করা শুরু করলো । এইসব করতে গিয়ে তাকে ছলনার আশ্রয় নিতে হল, সেই ছলনার বস্তুগত প্রকাশ হল নানা অবকাঠামো, নানা শিল্প এবং এইসব মিলিয়ে সে নির্মাণ করলো সভ্যতার রূপ । এসবের সৌন্দর্য অসীম, বলা যায় একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ এইসবের জন্যই বেঁচে থাকতে চায় । আর একটা বেঁচে থাকার উপাদান আছে, তা হচ্ছে প্রকৃতি, কিন্তু আসল লড়াইতো এই প্রকৃতির উপর দখল নেয়াই । সুতরাং সেখান থেকেও মানুষ বঞ্চিত হয়ে পড়লো । এক কথায় দেখা দিল ক্ষমতার বা শক্তির রকমভেদে একে অপরের সংগে লড়াই । যে যেমন ক্ষমতাধর, সে তেমন কুক্ষিগত করে, তাদের নীচে পড়ে থাকে অধস্তন মানুষের দল ।

‘অন্যকে ঠকানো’ একটি কুপ্রবৃত্তি অর্থাৎ সভ্য হওয়ার পথে এটা একটা প্রতিবন্ধক । একে ছেনি দিয়ে কেটে ফেলতে পেরেছে কি মানুষ ? পারেনি, একফোঁটা পারেনি । চারপাশের যে কোন মানুষের কাজের দিকে তাকান, দেখবেন সে সব সময় চেষ্টা করছে কি করে অন্যকে ঠকানো যায় । প্রায় প্রতিটি পেশার মানুষ এইকাজে লিপ্ত । কেন লিপ্ত ? কারণ এইকাজের মাধ্যমে সে যা নিজের অধিকারে নেবে তা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করবে, তার উপভোগ আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে । এই পথে সে ভাববে না যাকে ঠকানো হল তার অবস্থা, যাকে বলে স্বারথপরতার চরম পরাকাষ্ঠা ।
কেউ যদি সভ্য হতে চায় তাহলে ‘আমার অধিকারে’ রাখার জন্য যা করা হয় সেগুলি ছেনি দিয়ে কেটে ফেলতে হবে, মানুষ কি তা কেটে ফেলতে পেরেছে ? কিন্তু আমরা যে বলছি পৃথিবী সভ্য হয়েছে, মানুষ যা করেছে তার তুলনা নাই- সেসব কি সত্যের খাতিরে ঠিক ? প্রত্যেকটি মানুষ পৃথিবীর যা কিছু সম্পদ, তা সমান ভাবে ভোগ করতে পারে না, বলা হয় এক শতাংশ মানুষের  হাতে রয়েছে পৃথিবীর সিংহভাগ সম্পদ । তাহলে দেখা যাচ্ছে সভ্যতার নাম করে মানুষ যা করেছে তা হল বৈষম্যে ভরা একটা জগত গড়ে তুলেছে । নানা ভাগে বিভক্ত করেছে । এই বিভক্ত করতে গিয়েই তৈরি করেছে রাষ্ট্র । রাষ্ট্র মানেই একটি শ্রেণির অন্য একটা শ্রেণির উপর ক্ষমতার প্রয়োগ । যে ক্ষমতাশালী সেই কর্ণধার, সেই শোষক । শুধু রাষ্ট্র নয়, এটা করতে গিয়ে তৈরি করেছে নানা ধর্ম, এর কাজ একটাই বিভক্ত করা এবং শোষণ করা । তাকিয়ে দেখুন এর বাইরে আর কোন কাজ মানুষের নেই । তাহলে মানুষ কি প্রকৃত সভ্য হয়েছে ? হয়নি ।

আবার যদি আমরা বিষয়টিকে অন্যভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখবো মানুষের এই হয়ে ওঠায় কোন ব্যক্তি মানুষের দায় নেই, এটি কোটি কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় একে অপরের সংগে ইচ্ছা নিরপেক্ষ সম্পর্কে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় জড়িয়ে গড়ে উঠেছে । একে বদলে দেয়ার কোন ক্ষমতা একক মানুষের নেই । তাহলে দেখা যাচ্ছে সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে যা কিছু হয়েছে, তাইই হওয়ার ছিল, আমরা শুধু আমাদের শুভ আকাঙ্ক্ষা দিয়ে চাইতে পারি সেই রকম একটি পৃথিবী যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না । সম্মিলিত প্রচেস্তায় গড়ে ওঠা সভ্যতার সব সৌন্দর্য উপভোগ করবে সমান ভাবে । কিন্তু তা হয়নি ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সভ্যতা সবার জন্য একই রকম নয়, এটা শ্রেণির সভ্যতা, ক্ষমতাবানদের জন্য সভ্যতা । তাই বলছি যতদিন পর্যন্ত এই সভ্যতার যা কিছু উপাদান তা সকলের জন্য সমান উপভগ্য না হয়ে উঠছে, ততদিন মানুষ সভ্য হয়েছে বলা যাবে না । এই সভ্যতা খণ্ডিত, খণ্ডিত বলেই মানুষ তার ভেতরের কুপ্রবৃত্তি পরিত্যাগ করতে পারে নাই বরং ক্রমে আরও ধারালো এবং হিংস্র হয়ে উঠছে ।

আসুন, আমরা আমাদের অদিম প্রবৃত্তিগুলিকে ছেনি দিয়ে অনবরত কাটতে থাকি ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours