শুভশ্রী সাহা, লেখিকা, বারাসাত, কলকাতা:

লকডাউন: দৃশ্য-১

সময় দীর্ঘ হচ্ছে বড়। ফিকে হতে হতে দিন ছেড়ে এই সন্ধ্যা গমনে অনেকটাই এখন অলসতা মাঝে বেশ কিছুদিনের  বিচ্ছেদ যাপন যেন। চৈত্রের দুপুরের ফুটিফাটা রোদে পরিচিত শহরের কোন এক   মফঃস্বলী পাড়ার সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপ! হাঁক দেওয়া ফিরিওলা, আইসক্রিম,  মশলা মুড়ি,বড়িওলা, ছাপা শাড়ির পড়ে থাকা স্টকের সস্তার ডাক সমস্ত বন্দী কোয়ারেন্টাইনের তালায়। জঙ ধরা ডাকবাক্স হাসিমুখে তাকিয়ে আছে,বলছে দেখো আমি যে বহুদিন ধরেই বন্দী! নির্বাসিত! আচারের থালা নেই ছাদে, নেই কাকের ডাক, বদলে নৈঃশব্দ আছে। চুপকথা ফিসফিস করে সদ্য কচিপাতা আমডালে,এ বছর তেমন বউল নেই আমগাছে।, বউলরা কি জানতে পেরেছে তবে আমাদের কঠিন অসুখের কথাটা! লুকোনো গেল না তবে!  জানি না, তবে সোচ্চার দুপুরের পুলকারের হর্ণ,স্কুলগেটের  ঘন্টা, নীলসাইকেল, দুই বেণী, মোবাইল টোন, টিকটক হাসি, সব যেন নির্বাসনে গেছে। শহর এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরাচর ছুঁয়ে আলগা হয়ে জুড়ে আছেমাত্র! প্রতিকারহীন শ্রু শুষা  নেমেসিসের অমোঘ দন্ডটির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে। যে কোন সময়েই খাল্লাস! আর যদি ফিরেও রেখে যাবে সুগভীর ক্ষত। এই বন্দী শহরকে দেখতে চাই নি কোনদিন, তবু মনে হয় এইটুকু মেনে নিলে যদি শহরের কঠিন অসুখ সেরে যায়! ঘুম থেকে উঠে যদি আবার ভাত চায়, কর্মব্যস্ত শরীরে আবার প্রাণ সঞ্চার হয়! আহা! সব মেনে নেওয়া যায়! সব টুক! ভালোবাসি।
লকডাউন: দৃশ্য-২

অনেক টা সন্ধ্যা পড়ার পর ছাদে গেলাম জামা কাপড় তুলতে। বহু দিন পর এই কাজ গুলো করছি,তাই রাতের আকাশ এ ভাবে দেখাও হয় নি নিজের ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে। এও এক প্রাপ্তি। এই অপাপবিদ্ধ আকাশকে দেখে কোথাও কোনো মালিন্য আছে মনে হয় না।জাগতিক সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে নি:সঙ্গ চিত্তবাসনা। প্রতিটি তারা সুস্পষ্ট। এই বিস্তারে শুধুই মঙ্গল কামনা, স্বচ্ছতা রয়ে গেছে। সামনেই নববর্ষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সমাগত, নতুন জামাকাপড় বছর শেষে চৈত্র সেলের কত ছোট ছোট ব্যবসায়ী অগুনতি প্রতিবছরের পরিচিত ভেসে উঠল। এই তো পুজো আর নববর্ষ  বাকি তো বছর ভর শপিং মল বড় বড় নামী দোকানগুলির দৌরাত্ম্য। এদের আর চিহ্ন থাকল না এই বছরে। এই নিস্তরঙ্গ জীবনই কি আকাঙখিত ছিল আমাদের? আমরা কত অবসর প্রার্থনা করি, পাই না বলে জনে জনে আক্ষেপ জানাই, কিন্তু  এই অবসর কি ভার! কাম্য ছিল না এমন। তবু কাঙখিত সাড়ে তিন হাত জমির জন্য এইই সঠিক। কেটে যাবে ঠিক। মাঝখানে শুধু প্রকৃতি ফিরছে আগের ছন্দে। তিনি প্রত্যাখ্যান করলেও প্রণাম জানিয়ে যাব তাকেই।

লকডাউন: দৃশ্য-৩

লকডাউনের গতি এখন মন্থর। জনগণ কি ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠল তবে। যাদের না হলে আমাদের এক বেলাও চলে না তারা এসে টাকা নিয়ে গেছে। ওরা খাবে কি! বার বার জানতে চেয়েছে আমি কি একা করতে পারছি! এই প্রশ্ন এই ভাবনা মারণাস্ত্র ছড়ানোর আগে যদি সভ্যতা করত! যদি ভাবত আমি ছাড়া ওরাও খাবে! তাহলে কি একবার ও হাত কাঁপত না। আমরা মারণাস্ত্র কত সহজেই আবিস্কার করেছি কিন্তু প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে জীবন কেটে যায়।  আমাদের পাশের আমগাছ টা আজ উজ্জ্বল লাগছে। চৈত্রের ঘুঘু ডাকা দুপুরে এক অমল নির্লিপ্তি চেপে ধরে রাখে যেন। এক উদাসীন একাকীত্ব কুরে কুরে খায়। সেখানে আর গৃহ বন্দীত্বের দশা পীড়ন করতে পারে না। মনে হয় আমি আমরা আসলে সবাই একা।  দূরের বৃদ্ধাশ্রমের গেট টি বন্ধ। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের কলহাস্য প্রাতভ্রমণ বৈকালিক ভাবন সব বন্ধ বদলে ছায়া পড়ে আসা জানলায় একটি দুটি ভয়ার্ত মুখ। করোনা নাকি বয়স্কদের আগে ছোবল মারছে! কে না জানে তাদের ইমিউনিটি কম। লক ডাউনে সবাই সব জানে। বাদে নিজেদের আয়ুরেখা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: