প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, কলকাতা:

কৃষ্ণ দ্রৌপদীর বন্ধুত্বের রসায়ন  এক আলোকসামান্য উপাদান। না, যৌনতা নেই,কামনা নেই, নেই হাড়ের বুকে মাথা রেখে মাংসের আহ্লাদ। নারীটির তো মুখ্য প্রণোদনা ক্ষাত্র সংস্কার৷ এতো গণনা নয়, প্রামান্য সত্য যে, তিনি ক্ষত্রিয় বিনাশিনী। অন্তর্বিরোধ, প্রজাহিতৈষী প্রাণের প্রতিষ্ঠা তো তাঁর হাত ধরেই। তিনি তো পরম্পরা রহিত ক্ষত্রতেজের অনুপম মহিমা দ্যোতক৷ ভারতভূমিকে প্রথম রক্ষার অগ্রণী ভূমিকাই নিয়েছিলেন কুরুপাণ্ডব বংশীয়রাই৷ এতো আবেগী মনোরমের পৌরাণিক আলেখ্য বিচরণ নয়, এ ঐতিহাসিক সত্য। আসলে প্রতিস্পর্ধাকে অস্বীকার আলেকজান্ডারও করতে পারেন নি। ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক কৌশাম্বীর রাজা উদয়ন,  কুরুবংশীয় রাজা নীচক্ষুর বংশধর।

চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রীকরা ভারতে প্রবেশ করে  পাঞ্জাবের সমভূমিতে পূজিত হতে দেখে হেরোক্লিসকে৷ তারা জানতেন না এই হেরোক্লিস আর ভারতের  কৃষ্ণের সাযুজ্য। হেরোক্লিসের মা অ্যালকেমির রূপে আকৃষ্ট হয় অ্যামফ্রিট্রায়ন।

এই অ্যামফ্রিট্রায়ন ছিলেন অ্যালকমেনির স্বামী। জিউস ও অ্যালকমেনির মিলনে সন্তান হেরোক্লিস। তাঁর খ্যাতি, শক্তি, সহনশীলতা এবং কামপ্রবৃত্তি নিয়েও অনেক কাহিনি ডালপালা মেলেছে। এথেন্সের দার্শনিক জেনো যে দর্শন প্রবর্তন করেন, তাই স্টোয়িক নামে পরিচিত৷ এই দর্শনের আদর্শ হলো, আত্মসংযম,  সুখে নিস্পৃহতা এবং দুঃখে অনুদ্বিগ্নতা। স্টোয়িক দর্শনের কথা গীতার ৫৬ নম্বর শ্লোকে সম্যক রূপে পাওয়া যায়৷ কৃষ্ণের কালীয়দমনের মতো হেরাক্লিস বহুমাথাবিশিষ্ট সর্প হাইড্রাকে হত্যা করে।
প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথা আছে৷ গাত্রবর্ণের উপর সুদর্শন হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। ঠিক যেমন,  কৃষ্ণ এবং দ্রৌপদীর রূপ চামড়ার উপর ভিত্তি করে বিবেচিত হয় নি। "The beauty of a lady of any skin colour (as of any hair colour in Europe) was appreciated. (The culture and civilization of ancient India in historical outline)। গ্রীক পুরাণে আছে অ্যাকিলিসের মা থেটিস  তাকে স্টাই নদীতে  ডুবিয়ে অমরত্ব দান  করেন। শুধু সেখানে গোড়ালিটুকু ডোবানো হয় নি।

অ্যাকিলিস একদিন খালি গায়ে নগ্ন পায়ে মন্দিরে গেলে প্যারিস অ্যাকিলিস তার গোড়ালিতে তীর ছুঁড়ে হত্যা করে৷ এও কি সেই ব্যাধের হাতে কৃষ্ণের হত্যা!!এখানে কৃষ্ণকে অনৈতিহাসিক কল্পপুরুষ ভাবলে ভুল হবে৷ এই প্রসঙ্গে কোশাম্বি লিখছেন, ভারতে যিনি পরম উপাস্য জ্ঞানে পূজা পেয়েছেন, তিনি কৃষ্ণ। " দ্য হিরো অব দ্য যদুস " এ কোশাম্বি উল্লেখ করেছেন, "The creed which would survive to the twentieth century as the ", true religion " for millions in India was not to be Buddism.But the heterogeneous worship of krishna, a personal god to whom anyone could pray for succour in distress as one could not to the human teacher Buddha."

 কেন বন্টিত হলেন দ্রৌপদী!! কুন্তীর আদেশ!  কেন যুধিষ্ঠির তো বলেছিলেন, অর্জুন, "তুমি অগ্নিসাক্ষী করে দ্রুপদ নন্দিনীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করো!  সেখানে কই অর্জুন তো সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। ভীম তো আগেই বিয়ে করেছিলেন। কই হিড়িম্বাকে বলা হয়েছিল যে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত  ভীমের সঙ্গে থাকবে, কিন্তু সন্ধ্যা হলে তাকে ফিরে আসতে হবে পরিবারে৷ দ্রৌপদীকে তো এই শর্ত দেওয়া হয় নি!!  তবে কি যুধিষ্ঠির  বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর ভাইদের৷ আসলে দ্রৌপদীকে নিয়ে দ্বন্দ্ব ভাইয়ে ভাইয়ে, সংহতি নষ্ট কোনটাই চান নি তিনি। তবে যে অর্জুন  বীর্যশুল্কে জয় করেছিলেন তাঁকে, অভিমান কি বাসা বাঁধাটা খুব অপরাধ!! কেন হয়েছে অর্জুনের কাম জাগরণ৷ উলুপী, রাজনন্দিনী চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা হরণ, এখানে তো কৃষ্ণ নিজেই প্ররোচনা দিলেন। এখানে কি রসরসায়নে সাধনার সূত্রপাত ধরা যায়!!

আচ্ছা!  রাধা আর দ্রৌপদীর মিল কি খুব কম!  দুজনেই মাতৃরূপেণ সংস্থিতা রূপে পূজিত হয় নি। শুক্রগ্রহণ ও সন্তনধারণে রাধা অনাগ্রাহী। নারীর পুরুষভোগ পার্বতী কালিকার পথ বেয়ে রাধিকার এসেছেন। তিনি যে কালের সন্তান সে কালে তো কুন্তী স্বমীর পুরুষত্বহীনতার জন্য অন্যের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছেন৷ কিন্তু রাধিকার পুরুষতান্ত্রিক প্রলোভনের আকাঙখা ছিলো না৷ একই অনাগ্রহ দ্রৌপদীর। তিনি প্রতিবন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক আর শ্রুতসেনকে জন্ম দিলেও, এঁরা সবাই নিহত হয়। ইতিহাস তাঁকে মাতৃত্বের পরিচয়ে মান্যতা দেয় নি, দিয়েছে..  কৃষ্ণপ্রিয়া, পাঞ্চালী, অর্জুন অনুরাগিণী , যাজ্ঞসেনী হিসাবেই মূল্যায়ন করেছে।তবে রাধা অনেক বেশী ভাগ্যবতী ।  দ্রৌপদীর পরিধিটা রাধার মতো ব্যপ্ত নয়৷ সাধিকার স্বীকৃতি দ্রৌপদীর ভাগ্যে জোটে নি। তাই শাক্তভূমি বাংলার ভিখারি "জয় রাধা " উচ্চারণ করে ভিক্ষা পায়, "জয়তু দ্রৌপদী " শোনা যায় না৷

দ্রৌপদী কৃষ্ণপ্রাণসখী। রাধা ছাড়া অন্য যে নারীকে তিনি সর্বান্তকরণে ভালোবেসেছেন তিনি   দ্রৌপদী।
দ্রৌপদী স্বাধীনচেতা কিন্তু বুদ্ধিমতী৷ তিনি গোপ কুলবধূ নয়, রাজকুলবধূ, রাজারকন্যা।  তাই রাধাকে পরিত্যাগ করতে তিনি দুইবার ভাবেন নি, কিন্তু দ্রৌপদীকে ত্যগ করার কথা ভাবেন নি।  দুঃশলার স্বামী যখন দ্রৌপদীকে ধর্ষণ করতে আসেন, তিনি বোঝেন যে, এই নারী অন্য ধাতুর৷ কামার্ত  জয়দ্রথ তাঁকে প্রেম নিবেদন করলেও, তিনি তাঁকে ধুলোয় শুইয়ে দেন৷ আসলে তাঁর জীবন সময় মাপা। যজ্ঞের বেদীতে সূর্যের প্রতীক রূপে চক্রাকার সোনার থালা বুঝিয়ে দেয়, এই ভাস্করদত্ত থালা সৌর চালিত চুল্লি বিশেষ৷ তবু সখা, বিপদে আপদে "শরণাগত বৎসল ".. কেবল তিনিই  শ্রীকৃষ্ণ। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: