সীমন্তী দাস, লেখিকা, দুর্গাপুর:

প্রায় অর্ধশতক,আগের এক ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে শাল,পলাশে ঘেরা শিল্প শহরে একটু রাতের দিকে কোয়ার্টারের ছোট্ট বারান্দায় মায়ের কোল ঘেঁষে একটা মেয়ে শুয়ে আছে।
মাঝেই মাঝেই উঁকি দিচ্ছে বারান্দা থেকে, বাবা এল বুঝি। নটার নীল সাদা ডিউটির বাস কখন আসবে মা?

ম‍্যাড়ম‍্যাড়ে স্টিট লাইটের আলোয় শুধুই গাছের ছায়া।বারান্দার ঘুলঘুলি দিয়ে থালার মত চাঁদ দেখা যাচ্ছে।
মাদুরে তখনো ছড়ানো হারমোনিয়াম, তবলা।চায়ের কাপ কলতলায় ধুতে যাবার ফাঁকে স্টোভে তেল ঢালছে মা।পাশের বাড়ির টুনিদি এসে জিজ্ঞেস করে গেল,কাল প্রভাতফেরি কটায়?

কাল যে হোলি।রঙ,পিচকারি চাই।বাবা এখনো যে এলোনা। অবোধ শিশুর আবদারে মা যেন একটু জোরেই বলে উঠলো ,
হবে রে হবে।
মা কাজ সামলে আবার হারমোনিয়াম টেনে গান ধরে; "জ‍্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে"।ছোট্ট মেয়েটি,মাকে চেপে ধরে বলতো তুমি বনে যাবেনা।কোনো দিন না।মায়ের বুকে উঠে জাপটে থাকতো।
মায়ের বুকের শব্দের সাথে চাঁদের আলো মিলিয়ে ঘুম নামতো খুকির চোখে।
বাবা আসার আগেই সে ঘুমিয়ে কাদা।

ভোর হলো।মশারির ওপর পিচকিরি।বাবা বলে সে লাফিয়ে উঠলো বাবার বুকে।রঙ গুলো?
আছে আছে।মায়ের গলা।আগে মুখ ধোও।

সকাল থেকে সাজ সাজ বর।প্রভাতফেরি হবে।সকলে মিলে গান হচ্ছে, ওরে গৃহবাসী।বড়দের পায়ে ছোটরা আবির দিচ্ছে।তখন দোলের গান শিখতে হতোনা।এমনি এমনকি ই সব জানা হয়ে যেতো।ফাগুন হাওয়ায়, হাওয়ায়,বসন্তে ফুল,আরো কত কত গান।

সবার বাড়ি থেকে কিছুনা কিছু দিতো।নাড়ু,নিমকি,মিষ্টি।প্রথমে খেলেও,তারপর সেগুলো জমা হতো চিকচিকিতে।এই চিকচিকি খুবই মূল্যবান বস্তু।অধুনা পলিপ‍্যাকের মত সহজ লভ্য ছিলোনা সে।
কিছু দেহাতী পরিবার থাকতেন পাড়ায়।তারা ঢোল বাজিয়ে গান করতেন। অন্য ভাষা হলেও সুরের মাদকতায় পা নড়তে থাকতো।
ঐ সব বাড়ির বাচ্চারা বেশ বলশালী ছিলো।তাই লড়াইয়ে  হেরে যেতেই হতো ঐ মেয়েটি ও তার বন্ধুদের।তারাও খেপে গিয়ে বলতো বিহারী ভুত খাটিয়া মে শুত,খাটিয়া মে আগ লাগা তো ধরফরাকে উঠ।

কিন্তু হোলির আগে সন্ধি হয়ে যেতো।বাঙালি পক্ষের ভীষণ লোভ ছিলো চাচীদের বানানো সেও ভুজিয়া,বেসন লাড্ডু, চুড়া লাড্ডু র ওপর।
আর এপক্ষের হাতিয়ার ছিলো রঙ।
ওদের বুড়োদা পলাশ ফুল লোহার কড়াইয়ে সেদ্ধ করে পাকা রঙ বানাতো।সকলকে রঙের দিন পিচকিরি তে সেই রঙ  দিতো।ক্ষুদেরা সারা সপ্তাহ পলাশ তুলে আনতো।উনুনের জন্যে শুকনো কাঠ যোগাড়,ন‍্যাড়া পোড়ানোর কাঠকুটো জোগাড়ের ব‍্যস্ততার বাঙালি, বিহারীর ঝগড়া ধামাচাপা থাকতো বোধহয় সারা বসন্ত কালটাই।

ওদের এক নানী নন্দলালাকে মাখন,মিশ্রি দিয়ে ভোগ দিতেন।দোলের সকালে কলা পাতায় করে পাড়ার জনা কুড়ি বাচ্চা কে ঐ সুখাদ‍্য ননী দিতেন।ঐ অল্প ননীতে মন ভরতোনাএকটুও।তাই চাটতে চাটতে কলা পাতাটাই সাদা হয়ে যেতো।

এই গল্পের সাথে জড়িয়ে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর শহরের পঞ্চাশ বছরের রঙের উৎসবের ইতিকথা।

এই শহর নানা ভাষাভাষী মানুষের মিলন ক্ষেত্র।আর রঙ বা বসন্তের রঙে মিলতে হলে প্রাণের রঙে ফাগ মিশিয়ে নিতে হবেই।সেখানে ছোঁয়াছুয়ি ,জাতপাত, ধর্ম সব ই গৌন।নেই নাগরিক সভ‍্যতার নাচ উঁচু বাড়াবাড়ি।

শহরের প্রকৃতিও সেজে ওঠে,পলাশে,শিমুলে,মাদার ফুলে।এই শহরের গাছেরাই জানিয়ে যায় *বসন্ত এসে গেছে*।

হাড় ভাঙা খাটুনির পর কারখানার গেটে এক ভাড় চা নিয়ে চুমুক দিয়ে চোখ চাইতেই নজরে পরে পলাশের গাছে,সেই আদান্ত শ্রমিক মানুষটি তার দেশজ ভাষায় গুনাগুন করে হোলির সুর।তার বড় সাহেব কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়ে সেই মানুষটি খেয়াল ও ক‍রেনি।সলজ্জে গান থামাতেই এক বন্ধুর হাত এগিয়ে আসে গাওনা।গাও।খুব মনকাড়া সুরটা।

ঐ সুর মিশে যায় বাতাসে, বাবুর রবীন্দ্র ভাবনা আর শ্রমিকের মাটির সুর কোথায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় জন্ম নেয় এক নতুন সংস্কৃতি, যা একান্তই এই শিল্পাঞ্চলের। (ক্রমশ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours