সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

১৬১৬ : ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানতে পারে যে মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়।

১৬৫৭ : স্যার ক্রিস্টোফার রেন ডা. উইলিয়াম হার্ভে আবিষ্কৃত যন্ত্র ব্যবহার করে জন্তুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান।

১৬৬৬ : ডা. রিচার্ড লোয়ার সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। অবশ্য এর পরে পশুর দেহ থেকে মানবদেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের হাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ।

১৬৭৮ : রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপের নিষেধাজ্ঞা।

১৮১৮ : ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্যে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম বলেন যে, একজন মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেয়া যাবে।

১৮৬০ : প্রথম রক্তদানের যে মাত্র তিনটি ছবি এখন পৃথিবীর মানুষের কাছে আছে তার একটি।

১৯০১ : ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার দেখান, মানুষের রক্তের প্রধানত ৪ টি গ্রুপ রয়েছে, A, B, AB এবং O. প্রথমবারের মতো মানুষ বুঝলো যে, গত ২৭২ বছর ধরে তাদের ভুলটা ঠিক কোথায় হচ্ছিলো।

১৯১৪-১৯১৮ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এ সময়টায় যুদ্ধাহত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো। আর তখনই মানুষ আবিষ্কার করলো দুটো বিষয়। এক, রক্তদাতার শরীর থেকে বের করে নেবার পর ঐ রক্তকে জমাট বাঁধার হাত থেকে রক্ষা করা যায় যদি তাতে সোডিয়াম সাইট্রেট মেশানো হয়। দুই, অন্য আরও অনেক জিনিসের মতো রক্তকেও ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করা যায়।

১৯১৬ : প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করানো হয়। এই ধারণা থেকেই ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা ও মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন।
১৯২১ : লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে বৃটিশ রেডক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেন। সূচিত হয় বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত।

১৯২৫ : রক্ত পরিসঞ্চালন নিয়ে গবেষণার জন্যে মস্কোতে ড. আলেক্সান্ডার বগদানভের নেতৃত্বে একটি ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩৭ : আমেরিকার শিকাগোর কুক কাউন্টি হাসপাতালে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংক স্থাপিত হয়।

১৯৩০-৪০ : ড. চার্লস আর ড্র প্রথমবারের মতো রক্ত থেকে প্লাজমা ও লোহিত কণিকাকে আলাদা করেন।

১৯৩৯-৪০ : ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার এবং আরো কয়েকজন গবেষকের চেষ্টায় আবিষ্কৃত হয় রক্তের রেসাস ব্লাড গ্রুপ সিস্টেম। বোঝা গেল, কেন এতদিন একজনের রক্ত আরেকজনকে দিলে শারীরিক প্রতিক্রিয়া হতো।

১৯৫০ : কাচের পাত্রের বদলে প্লাস্টিকের ব্যাগে রক্ত সংগ্রহ শুরু হয় যা রক্ত পরিসঞ্চালন প্রক্রিয়াকে করে আরো নিরাপদ ও বিজ্ঞানসম্মত।

উপমহাদেশে স্বেচ্ছা রক্তদানের ইতিহাস

১৯২৫ : কোনো ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা নয় বরং শুধুমাত্র একজন রক্তদাতার দেহ থেকে একটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে রক্তগ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা নিয়ে ইম্পিরিয়াল সেরোলজিস্টরা কলকাতার ট্রপিকেল মেডিসিন স্কুলে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র শুরু করে।

১৯৩৯ : ভারতের রেডক্রস সোসাইটি একটি ব্লাড ব্যাংক কমিটি গঠন করে। এই কমিটি যন্ত্রপাতি দিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটিকে সহায়তা করে এবং রক্তদাতাদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করে। ফলে ফ্লাস্কে করে রক্ত সংগ্রহ করে তা কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

দেখে নিই প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালিন, বিশ্বযুদ্ধের সময়
(১৯৩৯-১৯৪৫) ভারত যুক্তরাজ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রীত ছিল, ব্রিটিশদের অধিনস্ত ভারতবর্ষে পাঁচশত দেশীয় রাজ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল; ব্রিটিশ ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ রাজ মিত্রশক্তির অংশ হিসাবে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করার জন্য দেড় লাখ সৈন্য পাঠিয়েছিল। ভারতের ব্রিটিশ শাষণ মিত্র শক্তির জন্য ভারতের সৈন্য বাহিনীও লড়াইয়ে জন্য প্রস্তুত।  সরকারি সিদ্ধান্তে মেজর জেনারেল ডব্লিউ সি প্যাটনের নির্দেশে কলকাতা ব্লাড ব্যাংক নামে সত্যিকার অর্থে ভারতের প্রথম ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউতে। রেডক্রসের ব্লাড ব্যাংক কমিটিকে সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

৬ মার্চ ১৯৪২- ১৫ মে ১৯৪৩ : যুদ্ধাহতদের রক্তের চাহিদা মেটানোর জন্যে ব্লাড ব্যাংক টিম ইংরেজরা, ইংরেজদের পরিচালিত ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকদের কাছ থেকে রক্ত ব্লাড ব্যাংকে সংগ্রহ হয়।

যুদ্ধের পরে ব্লাড ব্যাংকটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন রক্তদাতাদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার কোনো কার্যক্রম না থাকায় রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত নিয়েই রক্তের প্রয়োজন মেটানো হচ্ছিলো

১৯৪২ : সরকারি সিদ্ধান্তে মেজর জেনারেল ডব্লিউ সি প্যাটনের নির্দেশে কলকাতা ব্লাড ব্যাংক নামে সত্যিকার অর্থে ভারতের প্রথম ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউতে। রেডক্রসের ব্লাড ব্যাংক কমিটিকে সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

৬ মার্চ ১৯৪২- ১৫ মে ১৯৪৩ : যুদ্ধাহতদের রক্তের চাহিদা মেটানোর জন্যে ব্লাড ব্যাংক টিম ইংরেজরা, ইংরেজদের পরিচালিত ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকদের কাছ থেকে এই সময়ে ৩৯,০৫০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৫,৪৫৮ ব্যাগ রক্ত ব্লাড ব্যাংকে সংগ্রহ হয়।

যুদ্ধের পরে ব্লাড ব্যাংকটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন রক্তদাতাদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার কোনো কার্যক্রম না থাকায় রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত নিয়েই রক্তের প্রয়োজন মেটানো হচ্ছিলো।

চল্লিশের দশকে মেট্রোপলিটন শহরে এবং পঞ্চাশের দশকে জেলা শহরগুলোতে ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব ব্লাড ব্যাংকগুলোই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বলে অনেক বেসরকারি (commercial) ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়।

১৯৫৪ : ভারতের বিখ্যাত টাটা পরিবারের লীলা মুলগাওকার এর ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় এবং সে বেঁচে যায়। তখন থেকে লীলা মুলগাওকার ব্যক্তিগত উদ্যোগে রক্ত দান আন্দোলন পরিচালনা করেন ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত।

৪ আগস্ট ১৯৬২ : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ড. ত্রিগুণা সেন-এর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকেরা প্রথমবারের মতো মাসব্যাপী ব্লাড ক্যাম্প আয়োজন করে। ঐ ক্যাম্পে ৩০১ জন রক্ত দান করে।

১৯৭৫ : ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন এন্ড ইমিউনোহেমাটোলজি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে অক্টোবরের ১ তারিখ প্রথমবারের মতো সমগ্র ভারতে স্বেচ্ছা রক্তদান দিবস পালন করা হয়।

১৯৮৫ : স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথমবারের মতো ৩ দিনব্যাপী ন্যাশনাল সেমিনার এন্ড ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তখন থেকে গিফট অফ ব্লাড নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়।

৪ জানুয়ারি ১৯৯৬ : জনস্বার্থে ভারতের সুপিম কোর্ট ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সকল প্রকার রক্তের কেনাবেচা বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে স্টেট ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল গঠনের জন্যে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করে।

২০০৭ : ১৪ জুন, ২০০৭ বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।
(সূত্র: AVBD,WB)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours