দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

বসন্ত উৎসব বন্ধ হওয়ায় সমূহ ক্ষতির মুখে হস্ত শিল্পীরা। হোটেল ব্যবসায় ক্ষতি ২ কোটি।  জানা গেছে, শান্তিনিকেতন লাগোয়া আশেপাশের গ্রামের কুটির শিল্পীরা বসন্ত উৎসবের সময় বিভিন্ন হস্ত শিল্প সামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করে। এই সব গহনা উপহার সামগ্রী তৈরি জন্য কাঁচা মাল কিনতে বহু গৃহবধূ চড়া সুদে টাকা ধার নেয়। সেই জিনিস বিক্রি করে ধার শোধ করে লাভের মুখ দেখেন তাঁরা। কিন্ত এবার সেই আশায় ছাই। শিল্পী কবিতা রাই বলেন, "বাটিক, বাঁধনী, কাঁথা স্টিচ মিলে ৫০হাজার টাকার জিনিস তৈরী করেছিলাম। কি হবে? যেখানে বসন্ত উৎসব হলো না, সেখানে কে কিনবে?  মহাজনকে কি করে টাকা শোধ করব বুঝতে পারছি না।"

করোনা আতঙ্কের জেরে  বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসব বাতিল হওয়ায় সব থেকে ক্ষতি গ্রস্ত তাঁদের মত শিল্পীরা । অন্যদিকে, বিশাল অঙ্কের ক্ষতির মুখে হোটেল ব্যবসায়ীরা।  বিশ্বভারতীর বসন্তোৎসব ঘিরে বোলপুর শান্তিনিকেতন, কোপাই, প্রান্তিক, বল্লভপুর সোনাঝুরির মত পার্শ্ববর্তী এলাকা মিলিয়ে প্রায় চার শতাধিক হোটেল, লজ, রিসর্ট, বাংলো রয়েছে। যাদের সিংহভাগের বেশি সারা বছরের ব্যবসা হয় এই সময়ে। তিন দিনের প্যাকেজে হোটেল বুকিং হয়। ৬হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার প্যাকেজ থাকে এই সময়ে। শান্তিনিকেতন সমস্ত হোটেল এবার ও বুক হয়ে গিয়েছিল। কিন্ত বসন্তোৎসব বাতিল হতেই একলাফে ৮০ শতাংশ হোটেলে বুকিং বাতিল।  ইতিমধ্যেই হোটেল মালিকরা প্যাকেজ মোতাবেক খাবার জল, মুদির আনাজ সমস্ত মজুত করে ফেলেছিল। দুদিন আগে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের মাথায় হাত। শুধু হোটেল ব্যবসায় দুকোটি টাকার বেশি ক্ষতি বলে দাবি অ্যাসোসিয়েশনের। বোলপুর হোটেল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জগন্নাথ চ্যাটার্জি বলেন, " আমরা অথৈই জলে পড়ে গেছি। পর্যটন ব্যবসা শেষ। সব হোটেল মালিকরা জিনিস পত্র মজুত করে ফেলছে।  শেষ মুহূর্তে সব বাতিল হওয়ায় আমরা শেষ হয়ে গেলাম। এই ক্ষতি পূরণ কি করে  হবে? কি করবো?  কোরোনা ভাইরাসকে  তো উপেক্ষা করা যাবে না। মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।"
অন্যদিকে, সংগীত ভবনে শশ্মানের নিস্তব্ধতা। উৎসব বাতিলের খবর ছড়িয়ে পড়তেই অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মহড়ারত পড়ুয়ারা ৷ দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি বিফলে গেল বলে তাঁদের খুব মন খারাপ ৷গত তিন মাস ধরে নিরন্তর রিহার্সাল দিয়ে তৈরি হয় একটি নৃত্য নাট্য। তার জন্য শুধু ছাত্র ছাত্রীরাই নয় মন খারাপ অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের! সঙ্গীত ভবনের শতাধিক ছাত্র ছাত্রী  কার্যত শোকাহত। বিশ্বভারতী সূত্রে জানা গিয়েছে, এবছর শুধু বসন্ত উৎসবের মঞ্চে ৬ শো বেশি ছাত্র ছাত্রী অংশ গ্রহন করার কথা ছিল। আর বসন্তোৎসবের কালের শোভাযাত্রায় এবার দুহাজার ছাত্র ছাত্রীদের অংশ গ্রহনের জন্য প্রস্তুতি চলছিল। যে সব ছাত্র ছাত্রীদের ফাইনাল ইয়ারের তাদের মধ্যে করবী দে কুমকুম মুখার্জি বলেন, "এবছর আমাদের শেষ বসন্ত উৎসব তাই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের আলাদা আনন্দ ছিল কিন্ত সব শেষ হয়ে গেল। আবার কিছু করার ও নেই যে ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক তা অনুষ্ঠানে থেকে ও ভযাবহ। তাই মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই।"
এদিকে 'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্যনাট্য ফাইনাল রিহার্সাল শেষ হয়ে যাবার পর শুক্রবার যখন কর্ম সমিতির বৈঠক শেষে খবর আসে এবার আর বসন্ত উৎসব হচ্ছে না। তখন অনেকেই একে অপরকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সংগীত ভবনের ছাত্রী পাপিয়া রায়, শিল্পী মুখোপাধ্যায়রা বলেন," বসন্ত উৎসব দুদিন আগে সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের ফাইনাল রিহার্সাল হয়ে গিয়েছিল। তবুও কিছু করার নেই। মন খুব খারাপ তবুও সব মেনে নিতে হল।"
"বসন্তোৎসবের নৃত্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা' উপস্থাপনের জন্য দুমাস ধরে কযেকজন ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে একটি নান্দনিক মঞ্চ তৈরি করছিলেন অধ্যাপক সুধীর রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, চিত্রাঙ্গদা জন্য আমরা কয়েকদিন ধরে সবাই মিলে 'রবীন্দ্রসংগীত গবেষণা কেন্দ্রে' একটা সুন্দর কাজ করে চলেছি এটাই আমাদের সব থেকে বড় আনন্দ হয়ে থাকল। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হলে কারও কিছু করার নেই। "

 এদিকে, এদিন নতুন করে নির্দেশিকা জারি করে ক্যাম্পাসের মধ্যে কোন জায়গায় দোল না খেলার নির্দেশিকা জারি করেছে বিশ্বভারতী। এদিকে সোস্যাল মিডিয়া একটি ফেক নোটিশ ঘুরতে থাকায় দিনের শেষে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নতুন নোটিশ জারি করে জানিয়ে দেয় বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের মধ্যে কোথাও দোল খেলা যাবে না। বিশ্বভারতী জন সংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে কোথাও কোন রকম দোল খেলা হবে না। আমাদের ক্যাম্পাসে থাকা অতিথি নিবাসে সমস্ত বুকিং ও বাতিল হয় যাচ্ছে।বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বসন্ত উৎসব বাতিল করেছি। "

উল্লেখ্য, এই বছর ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য আশ্রম মাঠ ছেড়ে পৌষ মেলার মাঠে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল । এই প্রথম ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য সরকার বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছিল । সেই মত প্রায় সমস্ত রকম প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে বাতিল হল সেই অনুষ্ঠান।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours