প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

কাম্যক বনে উপস্থিত বিদুর ; কচ্ছ উপসাগরের নিকটস্থ তীরে পাণ্ডবদের সংসার ; মনে পড়ে!  এই বনেই দুর্ধর্ষ কিম্মীর বধ হয়। কৃষ্ণের সঙ্গে এসেছিলেন ভোজ, বৃষ্ণি এবং সম্পর্কের অনুগতরাও। "solidarity", নিয়ে আছে সরস্বতী তীর, এবার এলেন বিদুর, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমুখ৷ কেনই বা দ্যূতক্রীড়ার সভায় সবাই নিশ্চুপ থাকলেও, শুধু বিদুরই প্রতিবাদ করলেন!  তবে যে দ্রৌপদী উচ্চারণ করেছিলেন,
" কৃষ্ণঞ্চ বিষ্ণুঞ্চ হরিং নরঞ্চ ত্রাণায় বিক্রোশতি যাজ্ঞসেনী," আর তখন কে বস্ত্র জুগিয়েছিলেন!  তবে কি বিদুর! তিনি বলেছিলেন, "ততস্তু ধর্মোন্তরিতো মহাত্মা  সমাবৃণোদ্বিবিধৈর্বস্ত্রপূগৈঃ।"

এখানে তো মহাভারতকার বিদুরের নামটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন নি। এ যেন চৌকাঠ মাড়িয়ে ঠাঁই হওয়া সংশয়ের বুকে ঝুলে থাকা পারদ। কোথা থেকে এলো এতো কাপড়? মহাভারত বলছে ধর্ম স্বয়ং দিয়েছিলেন।  তবে যে প্রথমে দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে কাতর প্রার্থনা করেছিলেন। দ্বিতীয় ধাপে কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে ধর্মের কথা উঠে আসে। তবে সেদিন কৃষ্ণ কোথায় ছিলেন!  তখন তিনি শাল্বরাজ সৌভনগর ধ্বংস করতে গিয়েছিলেন।
তাই কি সেই মুহুর্তে দ্রৌপদীর অভিমান,
" আমার পতি নেই, নৈব ম পতয়ঃ,সন্তি ন পুত্রা, বন্ধু বান্ধব নেই, ন চ বান্ধবঃ,ভাই নেই, ন ভ্রাতরো, বাবাও নেই, ন চ পিতা,, এমনকি কৃষ্ণ,যিনি সকল সম্পর্কের ঊর্ধ্বে, সেই তুমিও নেই, নৈব ত্বং মধুসুদন।। "

দ্রৌপদীর অভিযোগে সেদিন কোথাও শ্বশুরের বিরুদ্ধাচারণ ছিলো না ; আত্মতন্ত্রী মেয়েটি কি সেদিন বাহুল্যবশত নাম উল্লেখ না করে কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন! ধর্ম দ্রৌপদীকে রক্ষা করেছিলেন মহাভারতকার বলেন ; কিন্তু কে এই ধর্ম!  ধর্মের উপস্থিতিতে সভায় মানুষের বোধের উদয় হয়। তাঁরা তখন দ্রৌপদীর গায়ে ও হাতের কাছে যা ছিল তাই ছুঁড়ে দেন তাঁকে। সমালোচকের ভাষায় এই ধর্ম আসলে কেউ নয়, স্বয়ং বিদুর।।প্রশ্ন আসবে তবে কি আড়ালে কথা! না তো!  আশ্রমবাসিক পর্বের ৩২ তম অধ্যায়ের ২১ সংখ্যক শ্লোকে বেদব্যাস স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, "যো হি ধর্মঃ স বিদুরো বিন্দুরো যঃ স পাণ্ডবঃ।শ্রদ্ধেয় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য সরল বঙ্গানুবাদে লিখেছিলেন, যিনি ধর্ম, তিনিই বিদুর, যিনি বিদুর, তিনিই যুধিষ্ঠির।
যা শারীরিক ও জৈবিক তাকে যৌগিক করে তুললে কি সত্য গোপন হয়!  পুরাণ অভিন্ন বার্তা দেয়৷ যেখানে পিতৃরূপে পিতৃপুরুষ সবকিছুকে ভোগ করে, সেখানেই তো পুত্রপিপাসা সাকার। আমরা আচ্ছন্ন সকলেই। মনে পড়ে গিলগামেশের শিক্ষা। শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্য সব শেষে মাটিতে লুটায়। এই পৃথিবীতে মানুষ নিজে না পেলে, তা পুত্রের মধ্যে পেতে চায়। এতো এক নতুন বোধি। ভাবনার বুকে বাসা বাঁধা সৈনিকের মতো যাপন কুণ্ডলী। কালের পথ চাহিদা কি বদলায়নি!  আত্মপরায়ণায় ভোগের বাসনা কি পুত্রতেই সীমাবদ্ধ! 
আচ্ছা! পুরুষের পত্নী কি জায়া!  " য" ও "আ" জুড়েই তো "জায়া" শব্দের সৃষ্টি। তবে কি পতিকে পুত্রের মাধ্যমে  পুনর্জন্ম দেন সেই পত্নী, তাই "জায়া"!
তবে যে পিতার ন্যায় পুত্রের তাগিদ চিরকালের। ভরতের তিন স্ত্রীর নয়টি পুত্র কোনো অংশেই ভরতের  মতো ছিলেন না। তাই তৎকালীন সময়ের দাঁড়িয়ে তারা কেউ সন্তানতুল্য হতে পারলেন না৷ অবশেষে সর্বসেনের কন্যা সুনন্দার গর্ভে জাত পুত্র ভূমন্যু...  ভূমন্যুং নাম ভারত।।

ক্ষেত্রজ উৎপাদন থেকেই তো বিদুরের জন্ম।শাস্ত্রকার শ্বেতকেতু বলেছিলেন, যা নারী পতির আজ্ঞা পাওয়ার পরেও ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনে আপত্তি করে, তার ভ্রূণ হত্যার পাপ হবে। অর্থাৎ স্বামী তার যৌনজীবনের চরম নিয়ন্তা।কালে কালে সামাজিক বিধির কারণেই রক্তমাংসের অজ্ঞাতরা এমন লোমশ প্রাণী হয়ে ওঠে৷ তবে যে বেদব্যাসের জন্মও পরাশর মুনি আর সত্যবতীর মিলনেই হয়েছিল। তাই সত্যবতী অম্বিকার সংগমের জন্য বংশ রাখতে নিজের কানীনপুত্রকে ডেকেছিলেন৷ কিন্তু বেদব্যাস তো কদকার ও বিশ্রী। অম্বিকার চক্ষু বন্ধ হয়ে গেলো৷ এবার অম্বালিকার অবস্থাও পাণ্ডুর রূপ ধারণ করলো৷ আর তাই আনন্দমগ্নার গর্ভে অম্বিকার নির্দেশে বিদুরের আগমন৷ আসলে সেসময়ে বিদুরের মতো ধর্মজ্ঞ কেউ ছিলেন না৷ আর বিদুর তো রতির মান রেখেছিলেন; তাই  আগলে যে রাখবেন ধর্ম, তা আর অতিরঞ্জিত কোথায়!! আগলে রেখেই তো সমর্পণের প্রেম, ভালোবাসার ডোর বন্ধন, সম্পর্কের তার, মনের মূল্যায়ন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours