চৈতালী সেনগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

    কষ্ট পাচ্ছি তাপস পাল, আপনার কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছি। আজ বাংলার চলচ্চিত্র জগতের একজন উজ্জ্বলতম তারকা অসময়ে কেমন করে খসে পড়লেন।এভাবে আপনার চলে যাওয়াকে মানতে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো অসামান্য প্রতিভার অধিকারী মানুষেরা ক্ষণজন্মাই হয়ে থাকেন। কুর্ণিশ জানাই আপনার কর্মদক্ষতাকে। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি সাধারণ মানুষের মনকে জয় করতে পেরেছিলেন আপনার অসামান্য অভিনয় দক্ষতা দিয়ে। সেই সময় বাংলার সিনেমা জগতের জ্বলজ্বল করে বিচরণ করছিলেন অপ্রতিরোধ্য মহানায়ক উত্তম কুমার, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এবং আরও অনেক সুদক্ষ অভিনেতারা। এদের মধ্যে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার মনে সাড়া জাগানো মুখের কথা নয়, আপনি পেরেছিলেন। ১৯৮০সালে তরুণ মজুমদার পরিচালিত দাদার কীর্তি সিনেমাটিতে এক সহজ, লাজুক, মৃদুভাষী,সত্যবাদী এবং সুরুচিশীল , সুন্দর মনের অধিকারী এক যুবকের অভ্যূত্থান হয়। তখনকার দিকপাল সুপুরুষ অভিনেতাদের মধ্যে আপনি নিতান্ত সাধারণ। তবু আপামর বাঙালি আপনাকে আন্তরিকভাবে ভালোবেসে মনের মনিকোঠায় স্থান দিয়ে ছিলেন। কত মা তাদের বেড়ে ওঠা  পুত্রসন্তানদের মধ্যে আপনাকে খুঁজতেন কে জানে?
      কত মানুষ তার ছেলে , ভাই, প্রেমিক হিসেবে আপনাকে কামনা করেছেন।এরপর একে একে শুরু হল আপনার দিগ্বিজয়ের পালা.... সাহেব, পারাবত প্রিয়া, ভালোবাসা ভালোবাসা, গুরুদক্ষিণা, আরও কত,কত,কত.....।এদের মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয় দুটি সিনেমা হল, 'দাদার কীর্তি' আর "ভালোবাসা ভালোবাসা'। সম্পূর্ন ভিন্নরূপী দুটি চরিত্র অথচ দুটি চরিত্রতেই আপনি ছাড়া অন্য কেউ এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো কিনা কে জানে? একটিতে আপনি দামাল, প্রাণবন্ত, প্রেমিক, বাঁচাল। আবার অপর চরিত্রে আপনি সরল,লাজুক, স্বল্পভাষি,শান্ত, সত্যবাদী। কিন্তু কোনটিতে আপনি অসৎ ছিলেন না। কত নিপুণ কর্মদক্ষতা দিয়ে আপনি চরিত্র দুটিকে উপস্থাপন করেছিলেন তার সত্যিই প্রসংশনীয় এবং চির স্মরণীয়। আমার বিশ্বাস ছিল কোন চরিত্রকে এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে তাকে চরিত্রটি ভালো করে বুঝতে হয়, তার গভীরে প্রবেশ করতে হয়।আপনি পেরেছিলেন। তবে আজ কেন সব এলোমেলো? সেদিনের সেই চরিত্রগুলি যেগুলো এতো অগণিত মানুষের মনের অন্তঃস্থলে আচড় কাটতে সক্ষম হয়েছিল আপনি কি তার মর্যাদা বুঝতে পেরেছিলেন? আমি জানিনা সত্যিটা কি, আজ আর জানতেও চাইনা। যখন টিভির পর্দায় দেখলাম আপনি কোন ঘরে লোক ঢুকানোর হুঙ্কার দিচ্ছেন,তখন বড় ধাক্কা পেয়েছিলাম জানেন?  আজও আমার মত গুণমুগ্ধ মানুষরা যারা একদিন আপনাকে কেউ নিজের ভাই, কেউ সন্তান,কেউ প্রেমিক এমনকি কখন কখন ভগবান ও ভেবেছেন তাদের কাছে এটা বড় প্রশ্ন।
    আমি/ আমরা আপনার গুণকে কুর্ণিশ জানিয়েছি, দোষকে নয়। আত্যাচার এবং অত্যাচারকে দমন করতে যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের হাতে চাবুক তুলে নিয়েছে। আপনার ওই একদিনের অসতর্ক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে কত বিতর্ক আর বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছে তা আপনি নিজেও ভাবতে পারেননি হয়তো। হয়তো সত্যিই আপনি অনেক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের স্বীকার  কি়ংবা আপনি দোষী, সে তো প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার, কিন্তু মুখের রে তীর একবার বেরিয়ে গেছে,তার তো আর ফেরানো যায় না। এমনটা চাইনি জানেন? আপনার এইভাবে চলে যাবার সময় আপামর বাঙালি কাঁদতে চেয়েছে হাউ হাউ করে, কিন্তু যখনই আপনার ঘৃণ্য মন্তব্যটি মনে পড়ছে উদাসীন হয়ে যাচ্ছ।
          এমনটা কি হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল? অনেকে বলেন যশ আর প্রতিপত্তির শিখড়ে পৌঁছে অনেক মানুষ তার হুঁশ খুইয়ে ফেলেন, পদস্খলন হয়। নিজের হাতে গড়া ভিৎটিকে যত্ন করতে হয়, লালন করতে হয়। অহংকারের বশবর্তী হয়ে অমর্যাদা করলে তা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়তে বাধ্য। আজ  অগণিত মানুষের আপনাকে আশীর্বাদ করে চিরবিদায় দেওয়ার কথা ছিল, তিরষ্কার করে নয়। আমরা বাঙালিরা, এবং বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আপনার কাছে ঋণী। আমরা সমৃদ্ধ হয়েছিলাম আপনার গুণকে।  সেকথা মনে করে আজ আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম। হে শিল্পী আপনি ভালো থাকবেন। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি। বাংলা চলচ্চিত্র আপনার অভাব সব সময় বোধ করবে।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours