রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

মেয়েটা কৃষ্ণকলি, বিবাহের বাজারে প্রতিবার প্রত্যাখাত। টেকো,বেশি বয়সী পাত্রপক্ষ অনায়াসে মূল্যের দাঁড়িপাল্লায় বিচার করে তার কার্যকারিতা,  পাত্র থেকে পাত্রের দাদা-ভাই-কাকা-জ্যেঠা প্রতিটা রোমকূপ পরখ করে লালসার দৃষ্টিতে। বাবা-মা কোনোক্রমে মেয়ে বিদায় করে সামাজিক মর্যাদা বাঁচাবার চেষ্টায় রত, হোকই না মেয়েটি পড়াশুনায় ভালো অথবা গানের সুরে রাতপরীদের নামাতে পারে জোছনাঘেরা প্রান্তরে। বিবাহের বাজারে সে তাও অচল আধুলিই, আজও রং-রূপ দিয়ে মানুষের গুণ বিচার হয় কিনা!! এই মেয়েই যখন পণের বাজারে বলিপ্রদত্ত হয়ে চারকাঁধে চেপে নাচতে নাচতে শ্মশানঘাটে যাবে, এই বাবা-মাই কাঁদতে কাঁদতে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বলবেন--" সব পাত্রপক্ষের দোষ"। হায় রে সামাজিকতা!!

ছেলেটা বেকার, ভালোবাসে উচ্চপদস্থ চাকুরীরতাকে। দুজনে বড্ড সুখী, শেষ বিকেলের মরা রোদ গায়ে মেখে গঙ্গাপাড়ে বসে ভাগ করে খায় ঝালঝাল বাদাম। গোধূলির রক্তিম সূর্যকে সাক্ষী রেখে স্বপ্ন সাজায় চারদেওয়ালের একটা ছোট্ট ঘরের, যেখানে অন্ধকারের মাঝে আলোকদীপ হয়ে উড়ে বেড়াবে জোনাকিরা। ছোট সংসার, যেখানে দিনের শেষে কাজ সেরে ফেরা পরিশ্রান্ত মেয়েটার কপালে হাত বুলিয়ে ক্লান্তি মুছিয়ে দেবে ছেলেটা, মুখের কাছে এগিয়ে দেবে পিপাসার জল, তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে দাবী করবে দেরী করে আসার কৈফিয়ত। যাকে মানাতে মেয়েটাকে মেহনত করতে হবে অনেকটা, বুটিকে অর্ডার দেওয়া দামী গোলাপ নয়, এক আঁচল শিউলি ভরে দিতে হবে তার আঁজলায়; তবেই মানবে সে।
কি হল? ভাবছেন নিশ্চয় এমন ছেলের সঙ্গে কিকরে মেয়েটির বিয়ে দেবেন? ছেলেটি বেকার, সমাজ কি বলবে? স্ট্যাটাস বলে একটা বস্তু আছে তো? পাড়াময় ফলাও করে প্রচার করতে হবে না জামাইয়ের আর্থিক স্বচ্ছলতার গল্প.... মেয়ে যতই অযোগ্য হোক না কেন!
মেয়েটি ছেলেটির থেকে প্রায় ছয় সাত বছরের বড়, ছোট্ট শিশুর মত আদরে স্নেহে আগলে রাখে তাকে। শাসন করে মায়ের মত, হারাতে ভয় পায় বড্ড। ছোট্ট প্রেমিকের এককথায় তার মেঝেতে সাজিয়ে দিতে পারে আকাশের চাঁদ, বুনোফুলের গন্ধে ম ম করে তাদের টালির চালার ছোট্ট কুটির।

কি হল? গা গুলিয়ে আসছে ঘেন্নায়? মনে হচ্ছে ছিঃ ছিঃ এ কেমন অবিচার!! মেয়ে ছেলের থেকে বড়? এভাবে তো ধ্বংস হয়ে যাবে সমাজব্যবস্থাটাই!! এতএব কান ভরো, ছিঃ ছিঃ রবে ভারী করে তোলো বাতাস, দোহাই দাও পারিবারিক মর্যাদার ; ওই যে কথাটা আছে না!! জন্ম দিয়েছি, তাই ইমোশনাল ব্লাকমেল করে নিজের সব দাবী(যদি তা অন্যায় ও হয়) মানতে বাধ্য করাটা আমাদের অধিকার।
আজ দুজনের কোনো সম্পর্ক নেই, দাঁতে দাঁত চিপে দুজনে দুজনের কাছে করে চলে অপরিচিত হওয়ার অভিনয়, সামাজিকতা যে বড় বালাই।

ছেলেটা ভালোবাসে তার চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট মেয়েটিকে। তার শত অভিমান, রাগ - হতাশা- যন্ত্রণাগুলো সহ্য করে পরম মমতায়। আউলবাউল ঝোড়ো মেয়েটাকে বটগাছের মত আগলে রাখে পরম নির্ভরতায়। শাসন - স্নেহ - আবদার - অভিমানের এমন কম্বো জুটি পাওয়া সত্যিই মুশকিল, তারা জানে একে অপরের চেয়ে আর কেউই সামলাতে পারবে না তাদের, কিছু মানুষ সত্যিই তৈরী হয় একে অপরের জন্য।
কিন্তু তাও তারা এক হতে ভয় পায়, আমাদের সমাজব্যবস্থা আর কিছু না পারুক প্যাঁক দিতে ছাড়েনা যে!! পরিবার সমাজের যৌথ চাপে হয়ত একদিন হেরে যাবে ভালোবাসা, এটা ভেবে প্রতিরাতে বালিশ ভেজায় তারা; ব্যস্ত শহরের দুই প্রান্তে। দিনের বেলা আবার করে যায় সুখী থাকার অভিনয়, ছেলেটার ঘামের গন্ধে মেয়েটা খুঁজে পায় নির্ভরতার আশ্রয়।

ডিয়ার সমাজবাদীস, আপনারা ঠিক কি চান বলুন তো? বাচ্চা পরীক্ষায় বেশী নম্বর পেলেও ফুসফুস করে আলোচনা করেন, আবার কম নম্বর পেলে ঢাক বাজিয়ে উদ্বাহু হয়ে নেত্য করেন, কেজানে খুনটুন করে ফেলল কিনা!!
বাচ্চা বেশি রোগা হলে বাবা-মায়ের চেয়ে বেশী ফাটে আপনাদের, আবার বেশি মোটা হলে এমন আঁতকে ওঠেন যেন তার চারবেলা খাওয়ার খরচটা আপনারাই চালান!! মেয়ের বয়স আঠারো হলেই এমনভাবে তার মা-বাবার কান ভরা শুরু করেন বিয়ের জন্য যেন তারা ঘরে সন্তান নয় অ্যানাকোণ্ডা বুনিপ টুনিপ পুষছেন, আচ্ছা ঠিক কোথায় সমস্যা আপনাদের? বাড়িতে খেয়ে কোনো কাজ নেই? ভোঁদড়েও দিচ্ছে না বুঝি!!

কিছুদিন আগে এক তথাকথিত শুভানুধ্যায়ী ( তিনি আবার আত্মীয় ও বটেন) আমার ইনবক্সে আমার কমেন্টবক্সের কিছু স্ক্রিনশট দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো ঠিক নয়, তুমি দিনদিন চরিত্রহীন হচ্ছো। এই তথাকথিত আত্মীয় আবার আমার কমেন্টবক্সে একটি মেয়েকে লাইন মারতে গিয়ে চরম ক্যালানি খেয়ে ব্লক হয়েছিলেন একবার, আমায় লাইন মারার ইচ্ছা থাকলেও সাহসের অভাবে প্রকাশ করে উঠতে পারেননি। এবার আমায় ইনবক্সে কেউ এককথার বেশি দুকথা বললেই পিরানহার কামড় খান, ইনি তো সোজা ফলার থুড়ি ভাগাড়ের চিকেন সাজিয়ে দিয়েছিলেন; অগত্যা এনার অবস্থা কি হয়েছিল পাঠকবর্গই কল্পনা করুন, আমায় আনফ্রেন্ড করে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন তিনি।

মোদ্দা কথায় আসি, " কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কহেনা" এই আপ্তবাক্যটি মনে রাখুন; করুন ওটাই যেটা আপনার মন চায়। জীবনটা আপনার, ভুয়ো সামাজিকতার দোহাইয়ে তথাকথিত আবালদের জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করবেন না..... নিজের শর্তে বাঁচুন; দোহাই আপনাদের।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours