নীলাঞ্জনা চৌধুরী, ফিচার রাইটার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও শিল্পোদ্যোগী, কলকাতা:

অকাল বোধনঃ ইনি কোন শ্রীরামচন্দ্র ?
শারদীয়া দূর্গাপূজায় দেবীর বোধন অনিবার্য। বিল্বমূলে, এই যে বোধন করা হয়, তা তান্ত্রিক ভাবধারা প্রভাবিত।  তাছাড়া সম্পূর্ণ দূর্গাপূজা পদ্ধতিই কিন্তু মূলত তান্ত্রিক, কিছু বৈদিক ক্রিয়া ছাড়া। আমাদের সাধারণ বাঙ্গালীর চোখে তা অবশ্য স্বাভাবিক। কারন, ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলা তন্ত্র প্রভাবিত। প্রশ্ন জাগে, আর্য কূলোদ্ভব শ্রীরামচন্দ্র বৈদিক নয়, তান্ত্রিক পদ্ধতিতে দূর্গা পূজা করলেন কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই বোধনের নাম “অকাল বোধন” কেন? শ্রীরামচন্দ্রের অকাল বোধনের কাহিনী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। বাংলা রামায়ণে এই বোধনকে "অকাল বোধন" বলা হয়েছে কেন? কারনটা হল, এই পূজা করা হয় সেই সময়ে যখন সূর্য দক্ষিণায়ণে আছেন, অর্থাৎ ২২শে জুনের পরে, সূর্য যখন বিষুব রেখার দক্ষিণে যাত্রা করেন। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সূর্য যখন দক্ষিণায়ণে যান, তখন দেবতাদের রাত্রি, অর্থাৎ তাঁরা নিদ্রায় যান। তাই দেবীকে সেই সময় বোধন করা মানে, তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ করা। অসময়ে করা, তাই অকালবোধন।
     এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, এই অকালবোধন এর কথা কিন্তু সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণে নেই, তাহলে এই কথা এল কোথা থেকে? আমারা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করেছেন কৃত্তিবাস, যা "কৃত্তিবাসী রামায়ণ" বা "শ্রীরাম পাঁচালী" বলে পরিচিত। এই কৃত্তিবাসী রামায়ণে অকালবোধনের কথা পাওয়া যায়। বাস্তবে কৃত্তিবাস রামায়ণের অনুবাদ করেন নি, তিনি রামায়ণের পুনর্লিখন করেছেন। কাহিনীর মূল অংশ এক ই , কিন্তু কিছু খুটিনাটি ঘটনার পরিবর্তন করেছেন। যেমন লক্ষণরেখার কথা বাল্মীকি রামায়ণে নেই। যাই হোক, এবার অকালবোধনের কথায় আসি, ব্যাপারটা এমন যে, মহাশক্তিমান রাবণকে সামনে দেখে শ্রীরামচন্দ্র ত একদম হতোদ্যম হয়ে গেছেন, সেই সময় ঋষি অগস্ত্য সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। ঋষি শ্রীরাম কে সাহস দেবার জন্য কিছু উপদেশ দিলেন। কি উপদেশ দিলেন? এই ব্যাপারে দুই লেখকের কথা আলাদা, বাল্মীকি বলছেন, ঋষি অগস্ত্য শ্রীরামচন্দ্রকে সূর্য উপাসনার কথা বলেন, যা "আদিত্য হৃদয়ম" স্তোত্র বলে পরিচিত এবং বহুপঠিত। কৃত্তিবাসী রামায়ণে আবার, ঋষি অগস্ত্যর বদলে নারদ মুনি, সূর্যের বদলে মা দূর্গার পুজার কথা বলেন, পরবর্তী কাহিনী সবার জানা। মনে হয় কৃত্তিবাসের সময়ে বাংলায় দেবী দুর্গার পূজা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, তিনি তা তাঁর লিখিত রামায়ণে যোগ করে দেন। কৃত্তিবাস প্রায় পাঁচশ বছর আগের মানুষ। তারও আগে নিশ্চয়ই দূর্গাপূজা বাংলায় বহুল প্রচলিত ছিল বলে মনে করাই যায়।
এছাড়া, সূর্যদেব একজন বৈদিক দেবতা,একজন প্রধান দেবতা হিসেবে, যাঁর পূজা প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী কালে প্রায় গত দুহাজার বছর ধরে বৈদিক দেবতার জায়গায় পৌরানিক দেবতা ( যেমন বিষ্ণু, শিব এবং শক্তি বা দূর্গা ইত্যাদি) পূজন শুরু হয়, যা আজও চলেছে।
    আরো অনেক তফাৎ আছে বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে। যেমন, রাবণ দ্বারা সীতা হরণ, বাল্মীকি রামায়ণে, রাবণ সীতা হরণের সময় এক হাতে সীতার চুলের মুঠি আর অন্য হাতে তাঁর ঊরু ধরে তাকে সোজাসাপ্টা উঠিয়ে নিয়ে যান। সেখানে লক্ষণ রেখার কোন উল্লেখ নেই। সত্যিকথা বলতে কি  শ্রীরামচন্দ্রের দেবত্ব, অর্থাৎ তাঁকে শ্রীবিষ্ণুর অবতার হিসেবে তামিল কম্ব রামায়ণে প্রথম দেখান হয়, এবং স্বাভাবিক ভাবে সীতাদেবী শ্রীলক্ষ্মী দেবীর অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার পরবর্তি হাজার বছরে অসংখ্য রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হতে দেখা যায়।সুতরাং তামিল কম্ব রামায়ণের সময়ে, রাবণ সীতাদেবীকে অমনভাবে স্পর্শ করছেন, তা সামাজিক ভাবে গ্রহনযোগ্য হতই না বরং তা ধর্মদ্রোহের সামিল হত। সুতরাং, কম্ব রামায়ণে রাবণ পর্ণকুটির শুদ্ধ সীতাদেবীকে তুলে নিয়ে যান।সে হিসেবে কৃত্তিবাসের লক্ষণ-রেখা, এই দুই এর মাঝামাঝি বলা যায়।
    আধ্যাত্ম রামায়ণের রামচরিতের দেবত্ব, অর্থাৎ তিনি যে ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তা কৃত্তিবাস ব্যবহার করলেন তাঁর রামায়ণে। বাঙ্গালী মননে শ্রীরাম চরিত্রের দেবত্ব যে অত্যন্ত আকর্ষনীয় হবে, অনন্য প্রতিভাবান কবি কৃত্তিবাস তা বুঝেছিলেন ও বাল্মীকি রামায়ণকে একপাশে সরিয়ে তিনি আধ্যাত্ম রামায়ণ অনুসরণ করে মানব রাম চরিত্রে দেবত্ব আরোপ করলেন। “রাম” নাম নিয়ে অশিক্ষিত দস্যু রত্নাকর হয়ে গেলেন মহাকবি বাল্মিকী। এই বহু প্রচলিত কাহিনী কিন্তু সম্পূর্ণ কৃত্তিবাসের। বাল্মিকী রামায়ণ ত নয়ই, এমন কি আধ্যত্ম রামায়ণেও এই কাহিনীর উল্লেখ নেই। এমনকি তিনি শ্রীরাম চরিতের অবতারত্ব প্রমাণ করতে, কৃত্তিবাস, শ্রীরামের পূর্বজ ভগিরথের কাহিনী সবিস্তারে রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত করলেন। এ কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণ বা আধ্যাত্ম রামায়ণে নেই, এ তিনি নিয়েছেন কালিদাসের “রঘুবংশম” থেকে। যেমন, অকাল বোধন তিনি পেয়েছিলেন “কালিকা পুরাণ” থেকে।
    এই লেখকেরা শুধু যে বাল্মীকি কেই অনুসরন করেছেন তা নয়,তাঁরা অন্য সংস্কৃত লেখা, যেমন, অদ্ভুত রামায়ণ, আধ্যাত্ম রামায়ণ আর অন্যান্য লোককথাও অনুসরন করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে মাত্র দুবার বাল্মীকির কথা উল্লেখ করেছেন।
    এবার প্রশ্ন হল, দীর্ঘদিন ধরে কৃত্তিবাসের রামায়ণকে , বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ ধরে নেওয়া হয়েছে কেন? কারণ একাধিক। প্রথমতঃ বহু রামকথা লেখা হলেও, কৃত্তিবাসের সময়ে, বাল্মীকি রামায়ণ ই একমাত্র রামায়ণ বলে প্রচলিত ছিল। অদ্ভূত রামায়ণ ইত্যাদির তেমন প্রচার ছিল না।দ্বিতীয়তঃ কৃত্তিবাস, তাঁর কাব্য কে ঠিক বাল্মীকির মত ই সাতটি কাণ্ডে বিভাজিত করেন ও প্রতি কাণ্ডের নামও একই রাখেন, সামান্য পরিবর্তন ছাড়া, যেমন বাল্মীকির “বাল কাণ্ড”, কৃত্তিবাসের পুঁথিতে “আদি কাণ্ড” , বাল্মীকির “যুদ্ধ কাণ্ড”, কৃত্তিবাসের পুঁথিতে “লঙ্কা কাণ্ড”। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, কৃত্তিবাস সহ এই লেখকেরা, মূল বাল্মীকির কাব্য অবিকৃত রেখে, তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির রূপ, রস,বর্ণ,গন্ধ এই মহাকাব্যে মিলিয়ে দিয়ে, এক নতুন মহাকাব্যের রূপ দিয়েছেন !!
    লক্ষনীয় ভাবে, তুলসিদাস, কৃত্তিবাস, কম্ব রামায়ণ প্রতিক্ষেত্রেই রামকথা সমসাময়িক নৈতিক,সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। তা শ্রীরামচন্দ্রকে, সাধারণ মানুষের আরও মনের কাছে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে, সবচেয়ে প্রাচীন কম্ব রামায়ণ, লিখেছিলেন তামিলদেশীয় কাম্বার সময়কাল খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক। এর পর এলেন কৃত্তিবাস, সময়কাল পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধ। তারপরে তুলসিদাস সময় কাল ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধ।
    কৃত্তিবাস ও তুলসিদাস দুজনেই ভক্তি আন্দোলনের সমসাময়ীক, যদিও তুলসিদাস আরো পরবর্তি লেখক। কৃত্তিবাসের বাঙ্গালা রামায়ণ লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সমন্বয় সাধন। সময়টা রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষ দিক, তুর্কি আক্রমণের ফলে কার্যত রাজ্যপাট ফেলে লক্ষ্মণ সেন পালিয়েছেন। সমাজ, জাত-পাত নিয়ে বহুধা বিভক্ত। তারমধ্যে, তুর্কি মুসলমানদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে অর্ধেকের বেশী ব্রাহ্মণ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সেই অবস্থায় হিন্দুদের মধ্যে একতার প্রয়োজন ছিল, হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তাই যে সময়, হিন্দু সাহিত্য, মহাকাব্য, ইত্যাদি ছিল একমাত্র অভিজাত শিক্ষিত, সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নাগালে। সাধারণ ছিল সে রসে বঞ্চিত। কৃত্তিবাস, বাংলা রামকথা লিখে শ্রীরামচন্দ্র ও আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে এক সেতু রচনা করলেন। যে মানুষেরা নিজেদের অভিজাত্যের আড়ালে, সাধারণ মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতেন, বিধর্মী আক্রমণের পর তাঁরাই ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন, সাধারণের সঙ্গ পাওয়ার জন্য। সেকারনেই, স্থানীয় ভাষায় মহাকাব্য পুনর্লিখনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যার ফলে, ভারতীয় হিন্দু মহামানবের বীরগাথা সমস্ত জাতিকে ঐক্যের, প্রতিরোধের, ঘুরে দাড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন দিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে। যেমন আজ ও দিয়ে চলেছে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours