প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

আমার ধাতৃমাতা রসবতী, যথার্থ মার্জিত। তাঁর স্বভাব স্থূল নয় ; স্ববিরোধিতায় তিনি পূর্ণ নন ; তবে কি নিত্য সচল প্রতিবাদ। হ্যাঁ, পঞ্চচূড়ার মন্তব্যটিকে  সবৈব ভাবে অস্বীকার করলেন না, আবার গ্রহণও করলেন না। আসলে আমাকে বয়সের সাথে ইচ্ছার উন্মুখ সাথী করতে চেয়েছিলেন,  তাই নারদ আর পঞ্চচূড়ার চাটুল কাহিনি তুলে এনেছিলেন৷ প্রাচীনকালে দেবর্ষি নারদ সর্বলোক পর্যটন করেছিলেন। ভ্রমণরত অবস্থায় অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দেখে বললেন, "নিতম্বিনী,তোমাকে কিছু বিষয় জিজ্ঞাসা করবো! " নারদকে উত্তর দেবেন না, এমন স্পর্ধা কি হতে পারে!  পঞ্চচূড়া তো পুংশ্চলী (বেশ্যা), তাই সময়ের সাথে পরিবেশের যোগ হবে এ তো বলাই যায়৷ কামিনীগণ সৎকুল সম্ভব, রূপসম্পন্ন ও সধবা হলেও যে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে। নারী হয়ে নারী প্রবৃত্তির চাটুবাক্য যে স্ববিরোধ, তবু রূপ বিবেচনায় মরা নদীর মরণ ফাঁদে কিই বা আশা করা যায়!! আচ্ছা!  তবে কি দেহপশরায় কেবলই সম্ভোগ! আর এই যে কামোন্মও, এও কি ধর্ম রক্ষা!!  কাষ্ঠ রাশিতে অগ্নি সংযোগ তো তৃপ্তি বিধান নয়, আগুনের গোলা ছুঁয়ে কাঙাল ক্ষুধা!! কি বলবে!  এও কি দোষের একক দাবানল।

জীবনের রতি তো ধর্ম, এতে লিঙ্গভেদ কেন!  শতেক আলোচনা নিয়েই আমরা কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলাম৷ মা জানতেন,  বিদুর মহারাজ বিচীত্রবীর্যের ক্ষেত্রে মূর্ধজা নামি এক দাসীর গর্ভে, কৌরবকুলের নিয়োগ পুরুষ মহর্ষি বেদব্যাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছেন। পরিচয় পেলাম পাণ্ডুর ; তিনি বলিষ্ঠ পুরুষ,  ব্যুঢ়োরোস্ক বৃষস্কন্ধ এবং প্রাজ্ঞদর্শন পুরুষ। তাঁর প্রসার জ্যোতি দর্শককে মোহিত করে। আসলে দৈহিক বলেই কি ভালোবাসা, না শ্রদ্ধা আসে বৌদ্ধিক রূপে। আসলে আমি নিজেও তো জন্মান্ধকে মেনে নিয়েছি, রূপে নয়, ঐশ্বর্যে, রাজমাতার তুল্যমুল্য বোধে৷ মা বললেন, কেবল মূর্ধজা রমণ প্রদানে ঋষি প্রণয় লাভ করেছিলেন। আসলে সাধনা অন্তরীক্ষ খোঁজে শস্যবীজ ঠোঁটে। মূর্ধজার মতো নারীর রমণ যে বিদুরের মতো সন্তানের জন্ম দেয়। মা চেয়েছিলেম আমার সাথে জ্যেষ্ঠ কুমারের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহ হোক। মা এইসময়ের দাঁড়িয়ে বললেন, তাঁর কাছে বর্ণভেদ নিতান্তই একদেশদর্শী এবং অর্থহীন।  মা মানতে পারতেন না যে, মূর্ধজা শুদ্র বর্ণের। কেন!  মহর্ষি দ্বৈপায়নের জন্ম সূত্র কি?  মা তো ধীবর কন্যা। এমন বর্ণবিদ্বেষ কেন!!

এবার আমার বরমাল্য অপেক্ষা। মা বললেন, অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র আমার বর ; কিন্তু ঋতুস্রাবের পর সত্যবতীর অনুজ্ঞায় অম্বিকা ব্যাসের নিকট নিজে না গিয়ে মূর্ধজাকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আমি বড়ো অবুঝ হই এই ক্ষত্রিয় রীতি নামক সংস্কারে৷ বিদুর তো সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, তবু তিনি রাজপদ হতে বঞ্চিত ; পাণ্ডু শ্বেত রোগে আক্রান্ত এবং পাণ্ডুর রোগে রুগ্ন ছিলেন। তিনি কুৎসিত যৌন ব্যধিগ্রস্থ। মহারাজ বিচীত্রবীর্য স্বয়ং যৌনরোগগ্রস্ত ছিলেন ; আর অম্বিকা ও অম্বালিকাও সেই রোগ বহন করেছেন। কিন্তু আমি এইসব ভাবছি কেন!  আমার ভাবী বর এমন রোগ বহন করছে না তো!  কুন্তী সৌভাগ্যবতী।  সে দুচোখে দেখবে পতিকে আর আমি!  আমি তো অক্ষিপটে আবদ্ধ। আচ্ছা!  আমি কি অসূয়াপরায়ণ হয়ে পড়েছি!  হ্যাঁ, অকপটে বলছি, আমি কোথাও কুন্তী ও পরাশবীর ভাগ্যে ঈর্ষা বোধ করছি। ঈর্ষাশূন্য নারী কি হয়!!  পুরুষও কি হয়!!
 এই সমাজে স্বীর্ণ ব্রাহ্মরেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছেন। মনে পড়ছে সত্যব্রতী কথা!  কুরু বংশের ভিত্তিমূল ধরে নাড়া দিয়েছিলেন তিনি। আজও ভাবতে অবাক লাগে,  একজন মহাজননী ঊর্ণনাভের জালে আটকে পড়ে গেলেন৷ ক্ষমতা নিহিত স্বার্থের কি পরিণাম। আজ মনে পড়ছে নিত্য রাত্রির সেই মহাকক্ষ, ধাইমার পুরাণ পাঠ..  আর আজ আমি নর্মসঙ্গীনী রাজার৷ রাজ্যপাঠ, দাস দাসী, সব আমার৷ শুধুমাত্র তিনি চক্ষুষ্মান নয়। তিনি আমার বিলাসের উপকরণে ভোগী।  পরনিন্দা, দল পাকানো ষড়যন্ত্র, এইসব দেখা তাঁর কর্তব্য নয়। তবে ঐশী তিনি, প্রীতি রমণীয় দক্ষ, চাতুর্যের অধিকারী। তবে মায়ের দৃষ্টি আর বোধের ক্ষমতা অমলিন। বললেন পাণ্ডুকে কোনোদিন জন্মান্ধ রাজা রাজ্যপাঠ দেবেন না। আর রাজা ঈর্ষার বীজ উপ্ত করেছেন তিনি, ক্ষেমাংকরী বুঝিয়েছেন। আমি অবাক হলাম, যে ধৃতরাষ্ট্র একশো পুত্র চান। আমি ছাড়াও নাকি নব নবতি সংখ্যক কন্যাকে বিবাহ করবেন তিনি। রাজা, রাজন্যকুল স্বেচ্ছাচারী, সুতরাং কেউ তো বলবার নেই। ভাগ্যিস আমাকে এই শতেক পুত্র জন্মের মতো আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্রয় দিতে হয় নি।  নাম হবে আমার, কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে অসম্ভব এইসব। আমি আজ গৃহস্থ শকট, জিরিয়ে নেবো কাল...  মায়াবী জীবনছায়া৷।

আমি এবার পট্টমিহিষী। আমার গর্ভে তিনসন্তান, এক কন্যা সন্তান। দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ এবং কন্যা দুঃশলা ছাড়া বাকি সব পুত্রেরা অন্যের গর্ভজাত। সংশয় তো আমার জীবন জুড়েই৷ আমার এক বৈশ্যা সহচরীর কোল জুড়ে তিনি দিলেন যুযুৎসুর মতো সন্তান৷ কি করবো আমি!  এ সমাজে দাঁড়িয়ে স্বামীর পরিতৃপ্তি অহংকার তৃপ্তিই আমার মূল লক্ষ্য৷ আমিও যে নারী ; বৈশ্যা পরিচায়িকা ছুঁয়ে আছে পট্টমহিষীর প্রাণ, তবু সে সূত মাগধি!! এটা ভাবতে অবাক লাগে, নবোঢ়া যুবতীগণকে পাণ্ডুই লুন্ঠন করে আনতেন৷ নিজের হাতে ভোগৈশ্বর্যে ডুবিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে৷ ভীষ্ম মদ্ররাজ শল্যের ভগিনীর সাথে পাণ্ডুর বিবাহ দিলেন৷ বিদুরেও বিবাহ দিলেন ; শুনেছি বিদুর একজন দক্ষ মহামন্ত্রী৷ বুদ্ধি, সাধু স্বভাব, অসামান্য স্নেহতেই তিনি মান্যতা পেয়েছেন। আমার স্বামী অন্ধ, তবু আমি বিদুরকে সম্মান করেছি। আমার পরম সুখ হতো, যদি তাঁকে পেতাম। ভালোবাসার আকর্ষণ নয়, প্রেমের আলোড়নে এ আমার কু সন্দেহ ছিল। আমি খুব সন্দেহ করতাম৷ কুন্তীর সাথে পাণ্ডুর আকর্ষণ,  গভীর সম্পর্কের মেলবন্ধন, উফফ! অসহ্য আমার। আমি ভেবেছিলাম, আমি অনেক কথা বলবো, অনেক আলোচনা করবো, পরিণতি আমি দেখে নেবো। পারলাম না, আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম ;তবে অহং আমার, প্রথম গর্ভবতী আমি আবার। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours