প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমানঃ

ঐক্য, পবিত্রতা, ত্যাগ ও প্রেমের মহিমময় বাণীতে ভাস্বর ভারতীয় ইতিহাস। অনাবৃতের হাওয়া বয়ে গেছে প্রজ্ঞা উত্তরণে; বুদ্ধের বাণী স্পর্শ লাগল যেদিন, আন্তরশক্তি উন্মেষের কাল শুরু হলো বহির্বিশ্ব জুড়ে। বুদ্ধদেবের আসার পূর্বে ভারতবর্ষ ছিলো আত্মনিবিষ্ট। অন্তর বাইরে তখন সংস্কৃতি সুসংগঠিত হয়৷ এই পটভূমিতে বুদ্ধের আবির্ভাব যে কতখানি সঙ্গত এবং মূল্যবান তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যবহারিক জীবনে থেকে বুদ্ধদেবের ভাবধারা আমাদের হৃদয়বৃত্তির নির্বাসন দেন। বুদ্ধদেব সমগ্র জাতির অন্যতম শিক্ষাগুরু। যদি জানতে চাই, আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রকৃত স্থান কোনটি তবে প্রাগবুদ্ধ ও বুদ্ধোত্তর কালের সর্বাত্মক আন্তরিকতা কে বুদ্ধতে হবে৷ আমরা ভুলে যাই " বৌদ্ধ " আর "বুদ্ধ " এক নয়। "বুদ্ধ " হতে হলে, বৌদ্ধ হতে হয় না। চেতনার প্রজ্ঞায় আবার জাতিভেদ হয় নাকি!! যে বোধ আমাদের প্রেম শেখায়, যে বোধ আত্তীকরণ করতে শেখায়, যে বোধ পবিত্রতা ও মহত্তর জীবনের সন্ধান দেয়, তা বুদ্ধ। স্বামীজীর মতানুযায়ী, বুদ্ধদেব হলেন প্রাগবুদ্ধ যুগে উৎসারিত উপনিষদের অধ্যাত্মিক ভাবসমূহের পূর্ণ বিগ্রহস্বরূপ। এডমন্ড হোমস " গভীরে গিয়ে বুদ্ধদেবকে অধ্যয়ন করেছেন। "The creed of Buddha " তে আমরা পাই, তিনি লিখছেন, "আমার মনে হয়, এ পর্যন্ত পাঠ করে পাঠক অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই জীবন সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের চিন্তাধারা এবং উপনিষদে সর্বোত্তমরূপে প্রতিভাত সুগভীর অধ্যাত্মদর্শনের শ্রেষ্ঠতম ভাবগুলি থেকে নিরূপিত আমার ব্যবহারিক সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে প্রকটিত মূল সুরটি একই। "
বুদ্ধদেব যাবতীয় সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি প্রদান করার কাজটিকেই জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রধান দুটি পর্ব বিদ্যমান। একটি হলো "অনাত্তবাদ ", অপরটি হলো " চরম সত্যের প্রকৃতি সম্বন্ধীয় মতবাদ"। আপাতত দৃষ্টিতে সত্তার স্বরূপ সম্বন্ধে উপনিষদে উচ্চারিত মহান ভাবসমূহ থেকে এক মৌলিক বিচ্যুতি বলে বোধ হলেও, যথার্থ অনুধাবন করাটা এখানে একান্ত প্রয়োজনীয়।কিন্তু চরম সত্য তো সবসময় ইতিবাচক।
রাইস ডেভিডস বলেছেন, "এই পরিব্রাজক জীবন গ্রহণের দুয়ার সকলের জন্য, এমনকি নারীদের জন্যও ছিল অবারিত। চিন্তা এবং মত প্রকাশের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হতো৷ " গৃহত্যাগের পর গৌতম গেছেন গুরু " আলার কালাম " কাছে৷ সেখান থেকে তিনি গেছেন "রাম পুত্র উদ্দকের "কাছে। এই যে সত্য ও শাশ্বত পন্থাকে অনুসরণ করা, এতো আমরা মুণ্ডকোপনিষদে পাই।  আসলে যে অষ্টাদশ ব্যক্তিকে অবলম্বন করে জ্ঞানরহিত কর্ম বিহিত হয়েছে, যজ্ঞ নির্বাহক সেই ষোড়শ ঋত্বিক, যজমান, যজমান পত্নী বিনাশী, তাঁরা অনিত্য।


অনিত্য বস্তুর পরিধি এবং তার লয় সম্বন্ধীয় বুদ্ধদেবের চিন্তাধারায় বলা হয়েছে -
" যে ধর্মা হেতুপ্রভবা তেষাং হেতুং তথাগতো হ্যবদৎ
তেষাং চ যো নিরোধো এবং বাদি হি মহাশ্রমণঃ-
হেতু থেকে উদ্ভূত সকল সত্তাকেই তথাগত বলেছেন হেতু। এই হেতুর ক্ষান্তি সাধিত হয় এই কথাই ঘোষণা করেছেন মহাশ্রমণ। বুদ্ধ নিত্যশুদ্ধসত্তা ছিলেন। বেদান্তে বলে, "নির্বিকল্প সমাধি " প্রাপ্ত হলে মন রূপ, চেতনা এবং দ্বৈতবোধের অতীত এক ক্ষেত্রে সমাহিত হয় ; এখানে ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব থাকে না৷ তিনি আত্মদীপ্ত, তিনি বুদ্ধ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours