আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুরঃ

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৈত্রী ও করুণার সম্পর্কে অভিনব উপলব্ধির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ভগবান বুদ্ধের সর্বত্রই লক্ষ্য ছিল অনির্বচনীয় আনন্দলোক প্রাপ্তি। কিন্তু অহংবোধ থাকলে সে আনন্দ কখনোই উপভোগ করা যায় না। তিনি বারবার বাসনা ত্যাগের কথা বলেছেন। বলেছেন মানুষকে সব সময় সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে হবে। শুধুমাত্র বাসনা বিলুপ্তি হলেই চলবে না। তাকে হতে হবে প্রেম, কল্যাণ ও মৈত্রী অভিমুখী। সমস্ত সত্ত্বা সুখী হোক-এই চিন্তা রবীন্দ্র সঙ্গীতেও জাগ্রত। যে সমস্ত গানে এই ভাবনা ব্যক্ত হয়েছে তার মধ্য থেকে কয়েকটি গানের তালিকা দেওয়া হল:- 
১ অন্ধজনে দেহ আলো
২ তোমারি সেবক করও হে
৩ পদপ্রন্তে রাখো সেবকে
৪ আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
৫ জীবন যখন শুকায়ে যায়
৬ তোমারি ইচ্ছা হোক পূর্ণ
৭ জরজর প্রাণে, নাথ
৮ ডাকিছ কে তুমি ইত্যাদি

বৌদ্ধ ধর্মে যেখানে জ্ঞান কর্ম ও আত্মশক্তির কথা বলা হয়েছে সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের অপূর্ব মিল।
রবীন্দ্রনাথের ধর্মাদর্শ ও বুদ্ধ ধর্মাদর্শের মধ্যে পার্থক্য হল নির্বাণ তত্ত্ব। বুদ্ধদেব বলেছেন সংসার থেকে মুক্তি লাভ করতে গেলে নির্বাণ বা পরম নিবৃত্তি লাভ একান্তই দরকার। মানুষের সকল দুঃখের মূলে আছে অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও মায়ার বন্ধন। জরা, ব্যাধি ,মৃত্যু, প্রিয়জনের বিয়োগ - অপ্রিয় সংযোগ প্রভৃতি দুঃখে পরিপূর্ণ এই জগত। এখানে কোথায় সেই আনন্দ বা সুখ!
পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ মুক্তির কথা বলেছেন তা শুধু সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ নয়, সে মুক্তির রুপ অন্যরকম।

"বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।"
রবীন্দ্রনাথ যে  বন্ধন এর কথা বলেছেন, তা হল আনন্দের বন্ধন, প্রেমের বন্ধন। সেই প্রেমেই আছে মুক্তির আস্বাদ, প্রেমের পূর্ণতা, প্রেমেই সত্যতা।
"প্রকৃতি তাহার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ লইয়া মানুষ তাহার বুদ্ধি, মন তাহার স্নেহ প্রেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না। সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না। তাহা আমাকে বন্ধ করিতেছে না। তাহা আমাকে মুক্তই করিতেছে। তাহা আমাকে আমার বাইরেই ব্যপ্ত করিতেছে। জগতের সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া প্রিয়জনের মাধুর্যের মধ্য দিয়া ভগবানই আমাদিগকে টানিতেছেন। আর কাহারো টানিবার ক্ষমতা নাই। পৃথিবীর প্রেমের মধ্যে দিয়া সেই ভূমানন্দের পরিচয় পাওয়াও জগতের এই রূপের মধ্যেই সেই অপরূপকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা ইহাকেই তো আমি মুক্তির স্বাদ বলি। জগতের মধ্যে আমি মুগ্ধ সেই মোহই আমার মুক্তি রসের স্বাদ। কবির কাছে এই ধরাতল স্বর্গের চাইতেও বেশি প্রিয়। তাই তিনি বারবার এই জগতের মধ্যেই আনন্দ ও বেদনার মধ্যে ফিরে আসতে চান।

"আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে।
দুঃখ সুখের ঢেউ খেলানো এই সাগরের তীরে।।
আবার জলে ভাসাই ভেলা, ধুলার 'পরে করি খেলা গো,
হাসির মায়া মৃগীর পিছে ভাসি নয়ন নীরে।।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
আঘাত খেয়ে বাঁচি না হয় আঘাত খেয়ে মরি।

এখানে উল্লেখযোগ্য এই গানটি কবি বুদ্ধগয়াতে বসেই রচনা করেছিলেন।

আবার দুঃখ ও মৃত্যু বা বেদনা বোধ বৌদ্ধ দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্জন করেছে। রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাব দর্শনেও বেদনার অভিঘাত যথেষ্ট। যেখানে বুদ্ধদেব বলেছেন বিশ্বের দুঃখ অগাধ ও অপর্যাপ্ত। এ দুঃখের কারণ নির্ণয় করে নিরোধের উপায় স্বরূপ দুঃখের একেবারে শিকড়ে কুঠারাঘাত করতে বলেছেন। অবিদ্যার ক্ষয় হলে সংস্কারের ক্ষয় ও বিজ্ঞানের ক্ষয় হলে নাম রূপের এবং বেদনার ক্ষয়। উপাদানের ক্ষয় হলে আর জন্ম নেই, জরা নেই, ব্যাধি নেই, মৃত্যু নেই, অর্থাৎ দুঃখ বেদনা নেই। রবীন্দ্রনাথ দুঃখের সমাধানের উপায় হিসেবে বলেছেন,
"দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?"
তিনি দুঃখের মধ্যেই আনন্দের সন্ধান পেয়েছেন। দুঃখের আঘাতে বেদনা তাড়িত হয়ে দুঃখেরই বক্ষের মাঝে আনন্দ স্বরূপকে লাভ করতে চেয়েছেন।

দুঃখ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। সহ্য করার ক্ষমতাও সকলের থাকে না। দেশের জন্য, অপরের জন্য দুঃখ বেদনাকে বরণ করে যারা জীবন উৎসর্গ করে, তাদের পক্ষে দুঃখকে বরণ করা সহজসাধ্য।
"নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।"

দুঃখকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে অতিক্রম করার সাধনা আমরা দেখতে পাই "নটীর পূজা"র নটীর চরিত্রে, "প্রায়শ্চিত্ত "নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর সাধনায়। এই সাধনাই "গীতাঞ্জলি"র "রাজা" নাটকেরও। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours