প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

আজ আমার আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমি প্রথম গর্ভবতী হয়েছি৷ আমার কুলের প্রথম গর্ভবতী!আমি রাজমাতা হবো। বিদুরের কাছে পৌঁছে যাক সে খবর। পরিশ্রান্ত পৃথিবীর বুকে এই কুলে আমার প্র‍থম সন্তান হওয়া চাই; আমি মহামান্যা বধূমাতাকে জানাতে চাই যে,  প্রথম জাত সন্তান আমারই ভূমিষ্ট হবে ; কিন্তু ভয় হচ্ছে আমার ; আমরই কি প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হবে!!  কিন্তু ওই যে!  ওই যে কুন্তীও সন্তানসম্ভবা ; আচ্ছা!  নিশ্চয়তা আছে কি!  এতো কম সময়ের ব্যবধানে ঘটনাটি আগে পরে হবে, এমন চিন্তা কি শেষ করে ফেলা যায়!  আমি কি তবে নদীর মতো অভিমান বয়েই যাচ্ছি। ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে সংশয়, আমার মনের স্বাদ তন্নতন্ন করছে ছেঁড়া ক্যানভাস। আমার সন্তান সম্ভাবনার অতিক্রান্ত সময়ের উপর আমি যেন ভরসা করতে পারছি না। কিন্তু, ভবিষ্যৎ কেউ কি বলতে পারে! 

সময়ের শেষে আমিই আজ রাজমাতা। পাণ্ডু তাঁর দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে গেলেন। শুনেছিলাম মৃগয়াদি আর প্রকৃতির অনুপম রূপ বুকে নিতেই তাঁদের যাত্রা। এরপর অনেক সময় চলে গেছে। পাণ্ডু চাইতেন না তাঁদের কেউ রণেভঙ্গ করুক৷ কিন্তু তবুও কি মন মানে!  বটপাতার মতো অক্ষর সাজিয়ে রেখে চলে গেছেন তাঁরা৷ আর তাঁরাই যদি রাজকীয়ভাবে নির্বাহ করতে না পারেন, তাহলে!!  আমি জানি!  আমার স্বামী তাঁকে ঈর্ষা করেন। আমিও ক্ষমতা আর ঐশ্বর্য রেখে ঈর্ষায় দগ্ধ হয়েছি বার বার; হ্যাঁ,করেছি ঈর্ষা, শেখানো ফুলপাতায় নিজেকে ঢাকতে পারি নি,  তবু নির্বেদ প্রাপ্ত পুরুষের বুকে ছুরিকাহত স্পৃহা আমার নেই। শুনলাম কুন্তীর এক ফুটফুটে পুত্র হয়েছে৷ নাম সংস্কার হয়েছে তার,  যুধিষ্ঠির; আমার মনে হয়েছে এই একচ্ছত্র অধিকার কেবল আমার হোক, এটা তো আমার জায়গায় থাকলে সবাই চাইবে ; কিন্তু তাঁদের যে ভালোবাসি না, এটা তো হতে পারে না৷ অন্ধ জোনাকি আমি, অধর চেপে জলে ঝাঁপ যে দেবো সেকি আর বিশ্বাসে বোঝাতে লাগে!  প্রণাম জানাই,  সেই শতশৃঙ্গ শৈলের তাপস জীবনে ব্রতী পাণ্ডুকে ; তাঁদের বিড়ম্বিত করতে চাই না আমরা ; তবে ইচ্ছা হলে ওনারা আসুন, অপেক্ষায় আছি, আমি গান্ধারী৷
আমার স্বামীর কুমন্ত্রণাদাতা খলচরিত্রের মন্ত্রী কনিকে আমার ঘৃণা হয়৷ মহারাজের দুর্বুদ্ধির মূলে আছেন তিনি। পাণ্ডুর প্রতি স্নেহানুভূতি আমি অনুভব করি। ওনাদের না ফেরার যন্ত্রণা আমায় ভাবায়৷ আসতে আসতে আমরা জ্ঞাত হলাম, পাণ্ডু ও মাদ্রীর মারা গেছেন৷ জ্ঞাত হলাম ১৬ বছরের যুধিষ্ঠির নীচে আরো ভ্রাতাদের নাম। তারইমধ্যে মাদ্রীর পুত্রদেরও কুন্তী আপন করেছেন। পাণ্ডুর এই না ফেরার শোকগাথা, অকালপ্রয়াণ আমাদের অনাথ করে দিয়ে গেছে বহুকাল৷ সর্বনাশা পিপাসাবরণ করেছে দূর্যোধনের শ্বাস। কনিক, শকুনি, সোমদত্ত বাহ্লীক, পরিপূর্ণ বিষে আমার সন্তান। কৌরবকূল তো অবিমিশ্রিত বর্ণের সম্ভার নয়, বরং মিশ্র কুলের সাজ। আর্য অনার্যের মেলবন্ধন কি ভুলে গেছে সমাজ!  কে আসে নি এই কৌরবকুলের বুকে৷ ধীবর, পাটনী যুদ্ধ করেছে, যৌন সংমিশ্রণে গড়েছে বিশুদ্ধতার উপন্যাস। আমি নারী হলেও বুঝতে পারি, ভেদাভেদের সরসী তীরে যে মেয়েটি একা হেঁটেছিল, সেখানে বিভক্ত নিত্য গল্প হয়ে উঠেছে৷ আচ্ছা! কুন্তীর মতো মানুষও ভ্রাতাদের তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখলেন! আর আমার স্বামী!  তিনি দুর্বলতার প্রতিরূপ পিতা হয়েছেন শতেকবার৷ কামনা, বাসনা, রিপু তাড়নাকে সংযত করতেই তো দম্ভের দাপুটে প্রভাব,তা আজ মৃত ঝড়।। এও কি মানা যায়!!

মাদ্রী আমার থেকে ছোট্ট, কিন্তু কুন্তী আমার পরম সখী। আমি যখন সব হারিয়েছিলাম, তখন কুন্তী আমায় ছাড়ে নি। আর মাদ্রী আর পাণ্ডুর শরীর যখন হস্তিনাপুরে আসে, আমি তখন তাঁকে ছাড়িনি৷ কিন্তু এই যুদ্ধ, এই পতন সব দোষ দূর্যোধনের!!  অসূয়াহীন সময়ের শরীর তাঁর পিতৃপুরুষেরা পরিচয় দিলেন কই!  আমিও তো মৎসর হয়েছি।আমি রাজমাতার লোভে, আকাঙ্খার গলায় মালা দিয়ে অবুঝ চৈতন্যহীন হয়েছি, আমিও দোষী৷ আমি তো জানতাম কর্ণের কথা। কিন্তু পাণ্ডুকে তো কুন্তী এই কর্ণের সত্যতা যথাসময়ে জানান নি, তাই এই কুললয়, ধ্বংসের মাটি, স্বপ্নকুঁড়ি শেষে বিনাশের ছায়া খুঁজেছি৷

কুন্তীর আয়ত চক্ষু, বার্তুল স্তন, প্রশস্ত নিতম্ব কি পুরুষ আকর্ষন করার মতো নয়!!  কুন্তী জানতেন পাণ্ডুর যৌনতা ; জানতেন লোলুপ বহুসন্তানের কামার্ত হৃদয়ের কথা, তবু সেই মুহুর্ত তিনি জানেন যে তিনি দগ্ধবীর্য৷ কুন্তী মা হলেন ; হ্যাঁ, যুধিষ্ঠির বিদুরের সন্তান। তবে তো নারীর স্বাধীন যৌন সম্ভোগের অধিকার দেয়নি সমাজ, কুন্তী মানেননি সেই কথা। তিনি স্বয়ংসিদ্ধা৷ অধিকারের শরীরে কিসের জাত, পূর্ণ কলসের শব্দহীন প্রাণ৷ কুন্তী নিয়োগ পুরুষের কাছে বার বার রতিপ্রার্থনা করেছেন৷ এতো পাণ্ড নিজে তাঁকে চেয়েছিলেন। তুল্যমূল্য হিসাবে ব্রাহ্মণের ঔরসে পুত্র উৎপাদন করাটাই কুন্তীর বিধেয়। পাণ্ডু হীনমন্যতায় ভুগতেন৷ বিদুরের আকর্ষণ তাঁকে একাধিকবার ঈর্ষান্বিত করেছে৷ আমার মনে হয়েছিল কিমিন্দম মুনির মৃত্যু,  পাণ্ডুর অভিশাপ কুন্তী আমাকে বললেও, একথাগুলি মিথ্যা৷ জন্মাবধি পাণ্ডু যকৃৎ রোগে আক্রান্ত৷ আর মায়ের কথা অনুসারে পাণ্ডুর সেইকারণেই অকস্মাৎ মৃত্যু হয়৷

কনিক, অগ্রজ শকুনি আর মা ক্ষেমাংকরী ঈর্ষা পরায়ণকারী৷ কুট,  রাজনৈতিক, অভিসন্ধি তাঁদের কব্জাগত প্রাণ। দূর্যোধনের ষড়যন্ত্র চক্র দেখেই আমি মহাধ্বংসের ছবি দেখেছি৷ এতো কুমারী অভিশপের মতো তরঙ্গ বাঁধন৷ যুদ্ধ সংসারের অকাম্যের কর্ম। আমি চাই নি, কিন্তু স্বার্থপরায়ণতা, ঈর্ষা, বিবেকহীন পুত্র প্রেমের পরিণতি ফসল..  আজকের আমি৷ একক ব্যক্তি কোনোদিন যুদ্ধে দায়ী হতে পারে না৷ যুদ্ধ হলো পোড়া বাদুড়ে গন্ধ, আর সংসার পরাগরেণু চাষ৷ সংযমে বোধ, রক্তপলাশের কান্না, বিবেকহীন অশুভ চক্র..  মৃত্যুর অপর নাম। (ক্রমশঃ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours