আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

বুদ্ধ ভাবনা আশ্রয় করে দুঃখ কেন্দ্রিক কবির যে চিন্তাভাবনা উদ্ভাসিত হয়েছে তার কিছু কিছু সন্ধান পাওয়া গেছে এই সমস্ত গান গুলিতে।

১ তোমারও অসীমে প্রাণ মন লয়ে
২ আবার যদি ইচ্ছা করো
৩ বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি
৪ আজি বিজন ঘরে
৫ আমার আধার ভালো
৬ এবার দুঃখ আমার
৭ অল্প লইয়া থাকি তাই
 ৮ না বাঁচাবে আমায়
৯ আমার সকল দুখের প্রদীপ ইত্যাদি।

বিভিন্ন বেদনায় জর্জরিত হয়ে জীবনের পরিপূর্ণ দর্শন থেকে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন একের পর এক গান। ঘাত প্রতিঘাতের কোন অভাব তার জীবনে ছিল না। বিশেষ করে মৃত্যুজনিত দুঃখ বেদনা থেকে হৃদয়ের বেদনার বহিঃপ্রকাশ বহু কাব্যে গানে প্রতিফলিত হয়েছে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন, শিশু বয়সের শিশুসুলভ আনন্দ, মাতৃ বিয়োগ শোকে রবি ঠাকুরকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। সেই শোক স্থায়ীও হয়নি।

 "দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন"--এই গানটিতে বলা হয়েছে যে সুখ-দুঃখ মরণ কোন কিছুই স্থায়ী নয়। মানুষের দুঃখ গভীর বিচিত্র ও অবর্ণনীয়...
"এই জীবনের ব্যথা যত এইখানে সব হবে গত
মরণ যে তোর নয় রে চিরন্তন--দুয়ার তাহার পেরিয়ে যাবি, ছিড়বে রে বন্ধন"...
মা সারদা দেবীর মৃত্যুর প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন "ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম তাহা সুখ সুপ্তির মতই প্রশান্ত মনোহর।"
তরুণ রবীন্দ্রনাথ যখন ২৪ বছর বয়স মারা গেলেন নতুন বৌঠান; কাদম্বরী দেবী। যাকে তিনি নিজের জীবনের ধ্রুবতারা আখ্যা দিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্যতম প্রেরণাময়ী ছিলেন এই নতুন বৌঠান। তার বিয়োগ-বেদনা কবি বোধকরি কোনদিন ভুলতে পারেননি। মৃত্যু ও তার পরবর্তী ফলাফল বেদনা, প্রথম উপলব্ধি করলেন জীবনে। সুতীব্র যন্ত্রণায় ভিতরে ভিতরে সাংঘাতিক ভাঙা গড়ার খেলা চলেছিল তরুণ রবীন্দ্র মননে।

এই মৃত্যু বেদনার বহিঃপ্রকাশ  "জীবনস্মৃতি"তে তিনি উল্লেখ করেছেন। আবেগ সুখ-দুঃখ শোক এবং বেদনার সংমিশ্রণে রচিত পান্ডুলিপি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে আজও সংরক্ষিত এই বেদনা যেন চির অক্ষত। জীবন মৃত্যু তিনি মনে করতেন একই জিনিসের দুই পিঠ। যেমন দিন রাত্রি। তাই জীবনের শেষ মৃত্যু নাও হতে পারে, হয়তো পালাবদল, কিংবা উত্তরণ।

"কভু করে গেনু খেলা, স্রোতে ভাসাইনু ভেলা, আনমনে কত বেলা কাটানু ভবে।।
জীবন হয়নি ফাঁকি,ফলে ফুলে ছিল ঢাকি,
যদি কিছু রহে বাকি, কে তাহা লবে!"

"কেন রে এই দুয়ার টুকু পার হতে সংশয়"? গানটির মধ্যে  মৃত্যুকে বা তজ্জনিত বেদনাকে উত্তীর্ণ হয়ে মানবজীবনেরই মানবাত্মারই জয় ঘোষণা করা হয়েছে। মৃত্যু যে জীবের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তা আমরা ভুলে যাই। জীবনে আশা আছে, ভরসা আছে, কিন্তু মরণের ওপারে শুধুই শূণ্যতা-অন্ধকার। মানুষ তাই মৃত্যুকে ভয় পায়। কিন্তু মরণ আছে বলেই না জীবনের এত মূল্য।
জীবনকে পরিপূর্ণ রূপে সেই উপলব্ধি করায়।

"এইদিকে তোর ভরসা যত, ঐ দিকে তোর ভয়!
জয় অজানার জয়।" (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours