রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

ট্রাফিক সিগন্যালে হাততালি দিয়ে যে মানুষগুলি আপনার শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির জানলার কাঁচের ফাঁক হতে হাত গলিয়ে দুটো পয়সা চায় তাদের দেখে নিশ্চয় বিরক্তিতে কুঁচকে যায় মুখের ত্বক? মানে মানে বিদায় করতে পারলে বেঁচে যান তাইতো? দুটো টাকা বাড়িয়ে দেন নিতান্ত ঘেন্নায়, কেন? ওরা আপনার মত স্যুটেড বুটেড অথবা নেলপালিশ রূপটানখচিত সমাজের প্রথম শ্রেণীর মানুষ নয় বলে?

অথবা যে মানুষগুলি জ্যালজেলে শাড়ি আর কমপয়সার প্রসাধনী মেখে ট্রেনে উঠে দুপয়সা চায় আশীর্বাদ করার বিনিময়ে? তথাকথিত বাবুদের তো ওদের দেখেই হৃদকম্প উপস্থিত হয়, আর বিবিরা? তাঁরা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কোনোক্রমে অশুচিতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন, যেন ছোঁয়া লাগলেই বাসা বাঁধবে কোনো মারণ রোগ, ওই মানুষগুলি যেন কোনো দাগী অপরাধী!! জানেন কি রাতের অন্ধকারে এক শ্রেণীর তথাকথিত ভদ্র বাবুরাই ওদের টেনে নিয়ে যায়, স্বল্প পয়সার বিনিময়ে বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার জন্য?

আর ওই যে পাড়ার ছেলেটি, নরমসরম স্বভাব ও মেয়েলি আচরণের জন্য যাকে নিয়ে খিল্লি করেন পাড়ার রকে। " হাফ লেডিস" " বৌদী" এইসব নামেই ডাকেন তাদের তাইনা? সন্তানের জন্য বাবা - মা লজ্জাবোধ করেন, সাইক্রিয়াট্রিস্ট, গাইনোকলজিস্ট দেখিয়ে যেনতেনপ্রকারণ ঠিক করতে চান এই দোষ!?

আর সেই মেয়েটি? বিদ্যায়, বুদ্ধিতে যে আপনাদের চেয়ে হয়ত কয়েকগুন এগিয়ে, আপনারা যখন কারো বিপদে পাশে দাঁড়ালে কতটা আখের গুছোতে পারবেন ভাবতে বসেন; সে তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্দ্বিধায় ; কোনোরকম প্রত্যাশা না করেই। তার পুরুষালি আচরণের জন্য তাকে " ষাঁড়া " উপাধিতে ভূষিত করেন পাড়ার রকে বসে। তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে তার রাত্রিযাপন নিয়ে রসালো কুৎসা ছড়ান, এমনকি তার পেট - বুকের খাঁজটুকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেপে নেন পরম উৎসাহে। কেন? তার স্বাভাবিক উন্নত জীবন আপনার ব্যর্থতায় লঙ্কাবাটা ঘষে দেয় বলে? নাকি নিজের বিকৃত লালসার অবদমনে হতাশায় ভোগেন আপনারা?
সমকামীতা আইন আজ বৈধ, প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিগত অধিকার বেছে নেওয়া আজ আইন স্বীকৃত। কিন্তু কতটুকু বদলেছে সমাজের মানসিকতা?  ঘরে - বাইরে প্রতিপদে হেনস্থা বন্ধ হয়েছে কি? এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা বক্স চালু হয়নি কিন্তু, তাদের সেই পুরুষ অথবা মহিলার ঘরেই টিক দিতে হয়।

৩৭৭ ধারা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সংশোধিত হওয়ার পরেই কিন্তু একটা ট্রেন্ড ফেসবুকে লক্ষ করা গেছে। কোনো পোস্টের কমেন্টবক্সে একটি মেয়ের সঙ্গে অপর একটি মেয়ের ঘনিষ্ট কথাবার্তা দেখলে তাকে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করা "৩৭৭?" কেন? আপনার সমস্যা কি মশাই? সমকামীদের আপনাদের মতই দুটো হাত আর দুটো পা আছে, ওরা অনেকেই কিন্তু আপনাদের চেয়ে সাংস্কৃতিকভাবে ও বুদ্ধিমত্তায় অনেক এগিয়ে, নিজের ব্যর্থতায় গাত্রদাহ হয় বুঝি?

কে কাকে ভালোবাসবে অথবা কার সঙ্গে জীবন কাটিয়ে সুখী হবে তা স্থির করার অধিকার কিন্তু স্বয়ং প্রকৃতিরই নেই,সমাজ তো অনেকদূর। পুরোটাই মন ও অনুভূতির ব্যাপার, যা বোঝার সাধ্য এখনো অনেকেরই নেই। আর যদি বলেন বংশগতির কথা, ১৩০ কোটির দেশে কিছু মানুষ যদি সন্তানের জন্ম নাই দেয় কিই বা আসে যায়? আপনি জন্ম দিন না, গণ্ডায় গণ্ডায়।

কারো ব্যক্তিগত পরিসরে আঙুল তোলা, বা সামাজিকতার জিগিরে ঘেন্নাচাষটা এবার বন্ধ করেই দেখুন! যে যেভাবে বাঁচতে চায় বাঁচতে দিন, আমার বা আপনার এতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না। খিল্লির স্রোতে এতটাও গা ভাসাবেন না যে একদিন আপনার সন্তান আপনার মানসিকতা নিয়ে খিল্লি করে। যুগ পালটাচ্ছে, আপনিও পালটে দেখুন। গোলাপ শুধু লাল হয়না, সাদা অথবা হলুদও হয়; এতে কিন্তু তার পরিচয় আলাদা হয় না। (সমাপ্ত)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours