শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

এর পর নাটক তরতরিয়ে এগিয়ে চলল। ১৯৩৭ সালের জুন মাসে প্রমথনাথ আলমোড়া থেকে গুরুদেবের লেখা একটি কার্ড পেলেন, যাতে লেখা, "বিশ্ব-পরিচয় থেকে আমার কলম এখনও ছুটি পায় নি।" প্রমথনাথ লিখেছেন, "এর কয়েক দিন পরেই শুনলাম খবরের কাগজে নাকি বের হয়েছে - আলমোড়ার সংবাদদাত‍া জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় নামে একখানি বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, বিশ্বকবির হাত দিয়ে এখানাই প্রথম বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনা। শুনেই মনে পড়ল ডক্টর সেনের কথাগুলি, তিনি কেন বইটার যুগ্ম-গ্রন্থকার হওয়ার কথা বলেছিলেন।"

আশীষ লাহিড়ীর ভাষায়, "পরের অঙ্কের ঘটনা প্রত্যাশা মাফিক চুড়ান্ত।"

"গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়নে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহনবাবু ও শাস্ত্রীমশায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, 'দেখো, বিশ্ব-পরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না।' একটু থেমে বললেন, 'অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, আর তা ছাড়া বিজ্ঞানের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষপর্যন্ত এই অব্যবসায়ীর সাহসে কুলাতো না। তুমি ক্ষুণ্ণ হয়ো না'।"

এই হচ্ছে বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত।

রবীন্দ্রনাথের বিশাল পরিচিতি এবং ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু অসহায় প্রমথনাথ 'ক্ষুণ্ণ' হয়েছিলেন কিনা, তা জানা নেই আমাদের। কথাটা সেই মুহুর্তে প্রমথনাথের কাছে মর্মান্তিক ঠেকেছিল সে বিষয়ে হয়তো আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি, বিশেষত কবির অনুরোধেই যখন বইখানি তাঁর লেখা। আশীষ লাহিড়ী বলেছেন, "আসলে ঘটনাটি যে তাঁকে কতখানি আঘাত দিয়েছিল তার প্রমাণ এই যে ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ বছর পরেও তার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি প্রায় দিনলিপির মতো করে প্রতিটি খুঁটিনাটির উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে খবরের কাগজের খবরটির কথা।"
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, সকল রবীন্দ্রভক্তরাই রবীন্দ্রনাথের মহান জীবনের এই অরাবিন্দ্রীক অধ্যায়টি নিয়ে প্রথমে যেন খানিকটা হলেও লজ্জিত হয়েছেন, এমনকি স্বীকার করতে বাধ্যও হয়েছেন, "কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে। গোড়া থেকেই প্রমথনাথের মনে কবি একটা প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। প্রথমে তো বলেছিলেন, বইটা প্রমথবাবুকেই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবেন, বিশেষ করে ভাষার ব্যাপারে। এটা বলা কতদূর সঙ্গত হয়েছিল, সেটাই প্রশ্ন।" এক্ষেত্রে আশীষ লাহিড়ী একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন, "লক্ষণীয়, ধীরেন্দ্রমোহন সেন যখন যৌথভাবে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথের নাম লেখক হিসেবে রাখবার প্রস্তাব করেন, তখন রবীন্দ্রনাথ সে প্রস্তাবকে আদৌ আমল দেন নি ; তখনও তাঁর কাছে বইয়ের মূল লেখক প্রমথনাথ, আর তিনি এর ভাষাগত ও সাহিত্যিক সম্পাদক। তাঁর মতে যদি-বা যৌথ-নাম দিতে হয়, তাহলেও প্রথম নাম থাকবে প্রমথনাথের।কিন্তু আলমোড়া থেকে কে বা কাহারা রটিয়ে দিল যে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিজ্ঞানের বই লিখছেন। অর্থাৎ ওখানে থাকাকালীন অবস্থা এতটাই আমূল বদলে গেল যে এমনকি দ্বিতীয় বা সহকারী লেখক হিসেবেও প্রমথনাথের নাম বিবেচনা করতে আর রাজি হলেন না তিনি।"

দীপঙ্কর বাবু বলেছেন, "ভাবলে মনে হতে পারে যে, প্রমথনাথকে 'বিশ্বপরিচয়' লিখতে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যদি নিজে দায়িত্বটা নিতেন এবং প্রমথবাবুকে দিয়ে পাণ্ডুলিপিটি পড়িয়ে নিতেন বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য, হয়তো ভালো হত। এমনকি শুরুতে না হলেও দুয়েক কিস্তি লেখা প্রমথনাথের কাছ থেকে পাওয়ার পরও যদি এই ধরণের প্রস্তাব স্পষ্ট ভাষায় দিতেন, মন্দ হত না।" কিন্তু এতকিছু স্পষ্টভাবে স্বীকার করবার পরেও যেনতেনপ্রকরণে দীপঙ্করবাবু বোঝাতে চেয়েছেন যে, "শেষ পর্যন্ত 'বিশ্বপরিচয়' একান্তভাবে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা বই।"

মোহ?

'আনন্দরূপম' গ্রন্থের ভুমিকায় প্রমথনাথ "শুধু সত্য কথা স্পষ্ট ও সোজা করে" বলবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কেন জানি না মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ নামক প্রতিষ্ঠানটির চাপে শেষপর্যন্ত সবকিছু স্পষ্টভাবে তিনি বলে উঠতে পারেন নি।

শেষে একটি তথ্য - রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর কয়েকের মধ্যেই প্রমথনাথ "ভাগ্যবিপর্যয়ে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত" হন।

আশীষ লাহিড়ীর ভাষায় - বুঝ লোক যে জান সন্ধান !

(সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র :
বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পুজারীবৃন্দ, অভিজিত রায় ফরিদ আহমেদ, মুক্তমনা ডট কম
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
আনন্দরূপম, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours